• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৯, ০৯:০১ পিএম

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তিতে বর্ণাঢ্য আয়োজন

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তিতে বর্ণাঢ্য আয়োজন
৪০ বছর পূর্তির বর্ণাঢ্য র‌্যালিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে বিশিষ্টজনেরা - ছবি : জাগরণ

 

বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পালন করল ৪০ বছর পূর্তি। হাজারো আমন্ত্রিত অতিথি, বর্ণিল সাজসজ্জা, র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

ঢাকার বাংলামটরে অবস্থিত কেন্দ্রটির প্রধান কার্যালয়। বিকালে দেখা যায়, প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে কার্যালয় আঙিনা পর্যন্ত দুপাশের দেয়ালে রংবেরংয়ের ক্যানভাস। আঙিনায় রঙিন আলপনা। ভবনের ভেতরে-বাইরেও রঙিন সাজ।

আগতদের বেশিরভাগ দেশিয় পোশাকে সেজেছেন। মেয়েদের খোঁপায় ফুল, পরনে লাল হলুদ শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি। হাত ভর্তি চুড়ি, গলায় মালা, কপালে বড় টিপ। ছেলেদের পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা।

সকালে শাহবাগ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। যা বাংলামটরস্থ প্রধান কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। র‌্যালির নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এ ছাড়াও ছিলেন- স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, লোকসঙ্গীত গবেষক মোস্তফা জামান আব্বাসী, টিআইবির চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আইএফআইসি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি এম শাহ আলম সরোয়ার প্রমুখ।

কার্নিভাল ঢঙে বর্ণিল, মনোজ্ঞ ও সুসজ্জিত র‌্যালিটি ১৮টি ভাগে সাজানো হয়। র‌্যালির দ্বিতীয় ধাপে রঙিন শাড়িতে ছিল ৩২ জন কন্যাশিশু। উল্লেখ্যযোগ্য ছিল- ঢাক-ঢোলবাদক দল, ভরতনাট্যম, কত্থক, মনিপুরী এবং গৌড়িয় নাচের দল, রংধনুর আদলে সাতটি রঙে সজ্জিত শিশুর দল, রঙিন শাড়ি পরে কলস কাখে মেয়ের দল, রোমান বাদক দলের সঙ্গে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাজে সজ্জিত দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, শিশুতোষ গল্পের চরিত্রে সজ্জিত দল, রঙিন পতাকা হাতে মানুষ ও সুসজ্জিত মোবাইল লাইব্রেরি।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল র‌্যালির নবম ভাগ। এ ভাগে ছিল বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব চরিত্র। চরিত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই র‌্যালিতে হাঁটছেন- সফক্লিস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, ফ্রয়েড, মহাকবি ফেরদৌসী, রুমী, মহাকবি গ্যাটে, শেখ সাদী, হাফিজ। আরও ছিলেন গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, হেগেল, ডারউইন, নিউটন, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিসসহ আরও অনেকে। জোয়ান অব আর্ককেও দেখা গেছে র‌্যালিতে।

বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম।

চৌদ্দতম ভাগে ছিল বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের জনপ্রিয় রূপকথার বেশ কয়েকটি চরিত্র। ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, পিনোকিও, অরুণ-বরুণ-কিরণ-মালা, সিনডারেলা, আলাদিনের জ্বীন, এমনকি শিয়াল পণ্ডিতও।

র‌্যালি শেষে দিনব্যাপী চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, চন্দনা মজুমদারসহ প্রায় ৫০ জনেরও বেশি শিল্পী মাতিয়ে রাখেন মঞ্চ। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে গৌড়িয়, মনিপুরী, কত্থকসহ বিভিন্ন ধরনের নাচ। ফাঁকে ফাঁকে চলে আলোচনাও।

উৎসবে প্রায় ৩০ হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের আপ্যায়নের জন্য বাঙালিয়ানা ধাঁচে পরিবেশন করা হয় দেশিয় সব খাবার। আকর্ষণীয় বাঁশের ঝুড়িতে করে অতিথিদের হাতে তুলে দেয়া হয় পাটিসাপটা, তেলের পিঠা, সিঙ্গারা, কদমা, খই, চিড়ার মোয়া, নিমকপাড়া, মুরালি, নকুলদানা, দানাদার, গজা, জিলিপিসহ আরও কিছু খাবার।

৪০ বছর পূর্তিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ -ছবি : জাগরণ

আমন্ত্রণপত্রটিও ছিল ব্যতিক্রম। এতে বলা হয়, দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে- “যতবার খুশি এবং প্রতিবার যতক্ষণ খুশি উপস্থিত থাকতে”।

অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমরা পাইনি আমাদের ছেলে-মেয়েরা পেয়েছে। আমার  মেয়ে ছোটবেলা থেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সদস্য ছিল। ও বর্তমানে প্রবাসী। আসলে অন্তত একবার হলেও ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সে। প্রবাসে থাকলেও ওর সাহিত্যজ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রীতি ওর ভালবাসা তৈরি করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোকিত মানুষ গড়ার যে উদ্যোগ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার নিয়েছিলেন তা দেশ গড়ার প্রত্যয়ে অত্যন্ত দূরদর্শী একটি ভূমিকা ছিল। আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ তরুণীদের সুন্দর মন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার বলেন, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আমার স্ত্রী সহপাঠী ছিলেন। আমরা তখন আলোচনা করতাম যে, কী করা যায়। তখন ছিল পাকিস্তান আমল। বাংলা সংস্কৃতির বিকাশকে তখন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা চলছিল। এর মধ্যে আমি আর্ট কলেজে পড়তে গেলাম। জয়নুল আবেদিন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, তুমি কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাস করেই চলে এসো। আমি যখন এলাম তখন দেখলাম এখানে যারা ছাত্র তারা শুধুই চুপচাপ করে ছবি আঁকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ওদেরকে বললাম- শুধু ছবি আঁকলেই তো হবে না, তোমাকে দেখতে হবে, জানতে হবে অনেক কিছু। তবেই তোমার মন প্রষ্ফুটিত হবে এবং তোমার ভাবনা প্রসারিত হবে। আর্ট মানে তো শুধু ছবি আঁকাকেই বুঝায় না, এর সঙ্গে সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্র বহুকিছু আছে। এসব কিছু নিয়েই আমাদের সংস্কৃতি গঠিত। আমি আর্ট কলেজে প্রথম বসন্ত উৎসব করলাম, এরপরে একটি নাটক করলাম ডাকঘর। এরপর টেলিভিশনে আমার সায়ীদের সঙ্গে দেখা। সায়ীদ যখন টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে তখন ওর বাসায় টেলিভিশন কেনার মতো অবস্থা ছিল না। 

তিনি বলেন, মানুষের উপকার করব, এই চিন্তা নয়, আমি উপকৃত হব, এই চিন্তা থেকে কাজ করলেই হয়। দায়বদ্ধতা নয়, কাজ করার আনন্দ নিয়ে কাজ করতে হবে। আমিই আমার উপকার করব। ভাল লাগা, এটা করতে ভাল লাগে তাই করছি। সায়ীদ যেটা করেছে। এখানে প্রগাঢ় একটা অনুভূতি কাজ করছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আরো অনেক দূর এগিয়ে যাক এই কামনা করি।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেটার কোনো তুলনা নাই। এখন সারা পৃথিবীর সব থেকে বড় সমস্যা হল কেউ বই পড়ে না। আমাদের দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এককভাবে এই কাজই করে যাচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যে ৪০ বছর পূর্তি হয়ে গেল, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, যেন এই তো সেদিন। এমন অসংখ্য ৪০ বছর পূর্ণ করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, এটাই চাই। আমি যদি দেখি, কোনও ছেলে বা মেয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যায়, তবে ওর সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা হয়। এমন অসংখ্য ভালো ছেলেমেয়ে তৈরি করুক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

উৎসব উপলক্ষে চারুশিল্পী মিলন রায়ের নেতৃত্বে একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী শিল্পী মাসব্যাপী কেন্দ্রকে সাজিয়ে তোলে মনোমুগ্ধকর রূপে। দেয়াল পেইন্টিং, ক্যানভাস, আলপনায় বর্ণিল করে তোলা হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয় চমৎকার একটি তোরণ।

আরেকটি টিম শিল্পী আব্দুর রহমান নূর ও স্থপতি সায়ইদা শারমিন সেতুর নেতৃত্বে কেন্দ্রের পুরাতন বিল্ডিংয়ের রেপ্লিকাসহ নানান রকম কারুশিল্পে সাজিয়ে তোলে উৎসব স্থল। এতে ব্যবহার করা হয় কাগজের ফুল, পমপম বল, মাটির হাড়ি, মটকি, মঙ্গল প্রদীপসহ লোকজ সব উপকরণ। সন্ধ্যার পর ঝলমলে আলোকসজ্জায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে কেন্দ্র।

সবুজায়নের জন্য ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ফ্লোরে টবে শোভা পায় নানা প্রজাতির গাছ।

অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করতে প্রায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক দিনভর ব্যস্ত ছিল। উৎসব উদযাপন কমিটি এবং বিভিন্ন উপকমিটির সদস্যরা প্রায় দু’মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।

আরএম/ এফসি