• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৩, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম

ফেসবুক প্রেসক্রিপশন, করোনার চিকিৎসা ও বিপদের ঝুঁকি

ফেসবুক প্রেসক্রিপশন, করোনার চিকিৎসা ও বিপদের ঝুঁকি

করোনার চিকিৎসা দরকার? চিন্তার কিছু নেই ফেসবুক খুলে বসুন। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেশ কয়েকটি তৈরি প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র পেয়ে যাবেন। আরো কিছুটা সময় নিয়ে খুঁজুন, পেয়ে যাবেন ডজনখানেক প্রেসক্রিপশন। প্রতিটির সাথে এক একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের নাম যুক্ত আছে। আমাদের দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ থেকে শুরু করে ভারতীয়, ইউরোপীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞদের নাম সম্বলিত প্রেসক্রিপশন ফেসবুকের বিভিন্ন পাতা ও গ্রুপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো কোনোটিতে মৃদু, মধ্যম ও সংকটময় করোনাক্রান্তের চিকিৎসায় কী কী ঔষধ ব্যবহার করা হবে তার তালিকা আলাদা আলাদাভাবে দেওয়া আছে। এমনকি আইসিইউ-তে ভর্তি রোগীকে কোন কোন ঔষধ দেওয়া দরকার সেটাও বলা হয়েছে। আপনার চারপাশে প্রচুর মানুষের দেখা পাবেন যারা এইসব প্রেসক্রিপশন মুখস্থ করে দিব্যি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে গিয়েছেন। এদের কাউকে একবার শুধু বলুন— “মনে হচ্ছে আমার করোনা হয়েছে।” তারপর পরে দেখতে পাবেন ম্যাজিকের মতো প্রতিক্রিয়া। এক নিঃশ্বাসে বলে দিবে আপনাকে  কী কী ঔষধ খেতে হবে এবং কী কী টেস্ট করাতে হবে। খাবার-দাবারের একটা তালিকা আপনার সামনে হাজির হবে। আপনি হয়তো মিনমিনে গলায় বললেন, “একজন ডাক্তার দেখাতে চাচ্ছি।” সাথে সাথে ধেয়ে আসবে বজ্র-ভাষণ— “রাখেন আপনার ডাক্তার, ওরা কি জানে? ওদের কাছে গেলেই নগদে নগদে আপনার পকেটটা কেটে দিবে। আমি যে ঔষধগুলোর কথা বলছি এগুলো খান। আরে এগুলো কি আমার কথা নাকি? বাংলাদেশের প্রফেসর আব্দুল্লাহ এবং আমেরিকার ডা. অ্যান্থনি ফাউসির প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে আরো লাগসই ব্যবস্থাপত্র বানিয়েছি। আপনি চোখ বন্ধ করে খেতে পারেন।” সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি— ফেসবুকের প্রেসক্রিপশনে যেসব সম্মানিত বিশেষজ্ঞদের নাম সংযুক্ত করা হয়েছে তারা কেউ এইসব প্রেসক্রিপশন দেননি। এগুলো সবই ভুয়া। আসলে এভাবে কি ঔষধ খাওয়া উচিত? এতে রোগীদের লাভ না ক্ষতি কোনটি হয়? পুরো বিষয়টির একটি বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।

সারা পৃথিবীতে ঔষধকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো ওটিসি (OTC—Over The Counter) ঔষধ। এগুলো কিনতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দরকার হয় না। এজন্য এদেরকে নন-প্রেসক্রিপশন ঔষধও বলে। এমনি একটি ঔষধ হচ্ছে প্যারাসিটামল। বাংলাদেশে এটি নাপা, এইস, রিসেট, রেনোভা ইত্যাদি বহু নামে পাওয়া যায়। ওটিসি বাদে সমস্ত ঔষধ হলো প্রেসক্রিপশন ঔষধ। নিবন্ধিত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত এইসব ঔষধ বিক্রি করা যায় না। যদিও বাংলাদেশে এই আইনটি একেবারে মানা হয় না। প্রতিটি ঔষধের বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। বয়স, ওজন, লিঙ্গ, গর্ভাবস্থা ও শরীরে বিদ্যমান রোগ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এনে প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ঔষধ নির্বাচন করা হয়। ফলে দেখা যায় একই রোগে আক্রান্ত দুইজন মানুষকে দুই ধরণের ঔষধ দেয়া হচ্ছে। ঔষধ নির্বাচন ভুল হলে সেটি রোগ সারানোর পরিবর্তে অবস্থাকে জটিলতর করে ফেলে। ঔষধের ভুল নির্বাচনে দুই ধরণের ক্ষতি হয়। একটি হচ্ছে ভুল ঔষধের জন্য অসুখের অবনতি হয় এবং ঔষধ নিজেও বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এই দুয়ের সহযোগে রোগাক্রান্ত মানুষটির শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। এজন্য ইংরেজিতে বলা হয় ‘No treatment is better than maltreatment’ অর্থাৎ অপচিকিৎসার চেয়ে চিকিৎসা না-করা উত্তম।

করোনাক্রান্ত রোগীদেরকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো উপসর্গবিহীন করোনা। আক্রান্তদের একশত জনের মধ্যে কমবেশি আশিজনের শরীরে কোনো উপসর্গ থাকে না। এদের কারো করোনা টেস্ট পজিটিভ হলেও তাকে ঔষধ দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাকি বিশজনের মৃদু থেকে তীব্র উপসর্গ থাকে। করোনার উপসর্গ কী কী? এই প্রশ্নের জবাব ‘ফেসবুকে জ্ঞান অর্জন করে’ যারা ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়েছেন তারা যত দ্রুত দিতে পারবেন, মেডিক্যাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে যারা ডাক্তার হয়েছেন তারা ততোটা তাড়াতাড়ি দিতে পারবেন না। করোনা ভাইরাস প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তিত করে। তেমনি করোনার উপসর্গ ও লক্ষ্মণ প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। চিকিৎসক মহলে কৌতুক করে বলা হয় ‘হাড়ভাঙা ও গর্ভধারণ বা প্রেগন্যান্সি বাদে’ করোনায় সব লক্ষ্মণ হতে পারে। তাই অতি দ্রুত করোনা হয়েছে বা হয়নি এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ঠিক না। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিস্তারিতভাবে রোগীর অসুস্থতার ইতিহাস জানতে হবে এবং রোগীর নিজস্ব অনুভবকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে বর্তমানে কী কী ঔষধ খায় সেটাও সাবধানতার সাথে জেনে নিতে হবে। তার পারিবারের রোগসংক্রান্ত ইতিহাস জানাও অপরিহার্য। অতীতে কোনো ঔষধ খাওয়া বা ইনজেকশন নেয়াতে শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে কিনা সেটাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। করোনার লক্ষ্মণ, তীব্রতা, শরীরে অন্য রোগের উপস্থিতি ইত্যাদির সাথে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার তারতম্য ঘটে। এরপর আসবে সঠিক ঔষধ এবং তার সঠিক মাত্রা নির্বাচন করা। এক্ষেত্রে ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো প্রেসক্রিপশনের গৎবাঁধা ঔষধের প্রয়োগ রোগীর ক্ষতি তো বটেই এমনকি তার মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

করোনারোগীকে দেওয়া ঔষধগুলোর মাত্রা রক্ষা করা অতি জরুরি। ধরা যাক, একজন করোনার রোগীর ডায়াবেটিস আছে। এই রোগীকে চিকিৎসার প্রয়োজনে উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দেওয়া হচ্ছে। ঔষধটি তার রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিবে। সেখানে ডায়াবেটিসের ঔষধকে কমিয়ে-বাড়িয়ে সুগারের মাত্রাকে ঠিক রাখতে হবে। এরকম কাজ কখনোই ‘ফেসবুক প্রেসক্রিপশন’ দ্বারা সম্ভব নয়। করোনার একটি লক্ষ্মণ হচ্ছে জ্বর ও পাতলা পায়খানা। রোগীটির করোনা টেস্ট পজিটিভ। ফেসবুক প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাকে ঔষধ দেয়া হচ্ছে। তারপরেও রোগীর অবস্থা ঘন্টায় ঘন্টায় খারাপ হচ্ছে। কারণ হলো পাতলা পায়খানা-বমির কারণে রোগীর শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম কমে যাচ্ছে। এটি ঠিক না করলে, করোনায় নয়, সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের কারণে মানুষটি মারা যাবে। এমন প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।  করোনাসহ কোনো রোগের চিকিৎসা যান্ত্রিকভাবে কখনোই করা সম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব জিনেটিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোকে বিবেচনায় রেখেই তার চিকিৎসার পরিকল্পনা করতে হয়।

আমরা ঔষধ গ্রহণ করি রোগমুক্ত হতে। কিন্তু ভুলভাবে নেওয়া ঔষধের কারণে ভোগান্তি বেড়ে গেলে সেটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। প্রতি বছর ভুল ঔষধ সেবনে সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ মারা যায়। ২০১৪ সালে খোদ আমেরিকাতে ভুল ঔষধের কারণে ছয় হাজারের মতো মানুষ মারা গিয়েছে। প্রতিদিন দেশে প্রচুর মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মারা যাচ্ছে। সঠিকভাবে চিকিৎসা না-হলে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। একেকটি মৃত্যু একেকটি পরিবারকে বেদনার অতল গহ্বরে ঠেলে দেয়। এজন্য আমরা কেউ করোনা আক্রান্ত হলে ফেসবুকের বায়বীয় প্রেসক্রিপশন অনুসরণ না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবো। যার যে কাজ তাকেই সেটা করতে দেওয়া উচিত। আমাদের জীবন একটিই, বোকামির কারণে সে-জীবন বিনষ্ট হোক এটা প্রত্যাশিত নয়। জীবনকে রোগমুক্ত রাখতে  বিদ্যমান সকল সেবা অবশ্যই আমরা গ্রহণ করবো।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ