• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৮, ২০১৯, ০৪:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৮, ২০১৯, ০৪:৫৩ পিএম

গতি কেড়ে নিচ্ছে রিকশা

গতি কেড়ে নিচ্ছে রিকশা
রিকশাজটে নাকাল নগরবাসী-ফাইল ছবি

......................................

রিকশার নৈরাজ্যে জর্জরিত ঢাকা

প্রতিদিন রাজধানীতে গড়ে বাড়ছে এক হাজার ৭০০ মানুষ

রিকশার চেয়ে চালকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ 

রাজউকের মাস্টার প্ল্যানে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ৫ লাখ 

 দেদার চলছে নম্বরপ্লেট বাণিজ্য 

......................................

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সজিব মিয়া। ১০ বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। এখন তার সংসার আলোকিত করেছে ৮ বছরের এক কন্যা ও ৭ বছরের এক ছেলে। লেখাপড়া না করে ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন সজিব। এতদিন গ্রামের বাড়িতে জমি চাষবাস করেই সংসার চালাতেন তিনি। সম্প্রতি এ কাজ আর তার ভালো লাগে না। তাই ক’দিন আগে ঢাকায় এসেছেন কাজের সন্ধানে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কারিগরি শিক্ষা না থাকায় শেষ পর্যন্ত তিনি ধরে নিলেন রিকশার হ্যান্ডেল। সজিবের মতো এমন লাখ লাখ যুবক এখন কৃষিকাজ ছেড়ে রাজধানীতে এসে রিকশা চালানোর কাজ করছেন। ফলে কৃষিকাজে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। পাশাপাশি যত্রতত্র এভাবে অদক্ষ চালকের দ্বারা রিকশা চালনায় ক্রমশ নগরীতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফলে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীর সৌন্দর্য ও গতি কেড়ে নিচ্ছে এসব রিকশা।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় এক সময় রাস্তায় চলাচলের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। আর এখন চলছে তা ৭ কিলোমিটারে। আগামী কয়েক বছরে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার গতিতে চলে আসবে, যা হবে হাঁটার গতির চেয়েও কম— এমনটাই আশঙ্কা করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, রিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকবার ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড (ডিটিসিবি) উদ্যোগ নিয়েও রাজনৈতিক কারণে কিছু করতে পারেনি। অথচ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক উত্তর সিটিতে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তারপরেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অবৈধ রিকশা সরাতে মাঠে নামছে না।

নগরীতে রিকশা নিবন্ধন বন্ধ থাকলেও ২৫টি সংগঠনের বাণিজ্যে ১২ লাখ রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই রাজধানীকে। সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে নবনির্বাচিত দুই মেয়রেরই প্রতিশ্রুতি ছিল নগরবাসীকে ‘ক্লিন ঢাকা’ উপহার দেয়া। উত্তরের মেয়র কিছুটা সফলতা রূপ দিলেও দক্ষিণের মেয়র রিকশা উচ্ছেদের ধারে কাছেও নেই।

রাজধানীর অলিতে-গলিতে, মহাসড়কে, ভিআইপি রোডে সবখানেই এখন শুধু রিকশা আর রিকশা। রিকশার নৈরাজ্যে জর্জরিত ঢাকা। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ও যানজট। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও রাজনৈতিক কারণে কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর যানজট নিরসনের বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবসম্মত নয়, প্রকল্পসর্বস্ব। এ কারণেই যানজট নিরসনে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ কাজে আসছে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, রাজধানীতে রিকশা থাকার কথা নয়। তাই এগুলোকে কমিয়ে ফেলতে হবে। প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। আর যেগুলোতে চলবে সেগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে চলার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরেক নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, সরকার চাইলে সব করতে পারে। তবে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক মানুষ রিকশা চালিয়ে সংসার চালায় তাদের কথা মাথায় নিয়ে ধীরগতিতে রিকশা উচ্ছেদ করবে বলে বিশ্বাস তার। তার প্রমাণ হিসেবে নগরীর কয়েকটি সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করাই মূল দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল ইএনএফপিএর পরিসংখ্যান মতে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ঢাকায় ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। এ হিসেবে প্রতিদিন রাজধানীতে গড়ে বাড়ছে এক হাজার ৭০০ মানুষ। এই বাড়তি মানুষের একটি অংশ ভূমিহীন, যাদের অল্প জমি আছে বাড়তি আয়ের জন্য তারাও ঢাকায় আসছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে, ঢাকায় রিকশার চেয়ের রিকশাচালকের সংখ্যা দ্বিগুণের কাছাকাছি। অর্থাৎ ১৫ লাখেরও বেশি। উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪১ সালে ঢাকায় রিকশা ছিল ৩৭টি। ১৯৪৭ সালে বেড়ে হয়েছিল ১৮১টি। সে সময় বিদেশ থেকে ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে রিকশাও আনা হয়েছিল। রিকশা নিয়ে ঢাকাবাসীর ব্যাপক কৌতূহলও ছিল সে সময়। সেই রিকশাই এখন ঢাকাবাসীর যন্ত্রণা। বর্তমান সময়ে নগরীতে ১৯ ধরনের যান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে একই রাস্তায় চলছে রিকশা, রিকশাভ্যান, ঠেলাগাড়ির মতো অযান্ত্রিক যানবাহন। সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ইজিবাইক। আর এসব মিশ্র পরিবহন চলাচল করছে লেনবিধি না মেনেই। ফলে সড়কে দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রাজধানীর রাস্তায় সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলতে পারে। সেখানে চলছে ১২ লাখেরও বেশি রিকশা।

সরকারের আরএসটিপির সমীক্ষা প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, নগরীর প্রধান সড়ক, বাইলেনসহ বিভিন্ন সড়কের ৯৫ শতাংশেই রিকশার আধিক্য। নগরীতে রিকশার সংখ্যা কত এর কোনও সঠিক হিসেবও দুই সিটিতে নেই। রাজউকের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ৫ লাখ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে তারও বেশি। 

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, রিকশা চলছে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেমপ্লেট লাগিয়ে। একেক এলাকায় একেক ধরনের নেমপ্লেট। নগরীতে চলাচলের জন্য রিকশার লাইসেন্স বা নম্বরপ্লেট দেয়ার এখতিয়ার একমাত্র দুই সিটি করপোরেশনের। অথচ সেই নিয়ম অমান্য করে রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং পুলিশের সহযোগিতায় বিভিন্ন সংগঠনের নামে রিকশার নম্বরপ্লেট বিতরণ চলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই  প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকলীগের ব্যানারে শুরু হয় রিকশার নম্বরপ্লেট বাণিজ্য। ইতোমধ্যে কয়েকটি সংগঠন নম্বরপ্লেট বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ইনসুর আলীর নেতৃত্বাধীন সংগঠন জাতীয় রিকশা শ্রমিক লীগের ব্যানারে ৫০ হাজারেরও বেশি রিকশা চলছে। এছাড়া রিকশাকেন্দ্রিক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সংখ্যা ৩৫/৪০টির মতো। এরমধ্যে ১৮টি সংগঠনের নামে রিকশার নম্বরপ্লেট ব্যবহার হয়ে আসছে। এসব সংগঠন বিভিন্ন সরকারের আমলে নির্দিষ্ট নম্বরপ্লেট বিতরণের ক্ষমতা প্রাপ্ত বলে দাবি করছে। যেমন- ১৯/ডি টোলারবাগ মিরপুরের ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক সমিতি। সিটি করপোরেশনের বাতিলকৃত ৮ হাজার ৫৪৪টি রিকশার নেমপ্লেট বিতরণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই সংগঠনের নামে হাজার হাজার রিকশা চলছে নগরীতে।

ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প যানজট নিরসন ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতে রিকশা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক অনেক আগেই ঢাকা শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করেছে। এরই মধ্যে নগরীর শাহবাগ থেকে ফার্মগেইট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে মিরপুরসহ কয়েকটি প্রধান রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

টিএইচ/এমএইউ/এসএমএম