• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০১৯, ১১:২৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১২, ২০১৯, ১১:২৯ এএম

বেহাত হচ্ছে রাজধানীর পুরাকীর্তিগুলো

বেহাত হচ্ছে রাজধানীর পুরাকীর্তিগুলো
চকবাজারে অবস্থিত জাহাজবাড়ি

বেহাত ও নষ্ট হচ্ছে রাজধানীর পুরাকীর্তিগুলো। সরকারি গেজেট প্রকাশের ৭ বছরেও ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোর এলাকাই চিহ্নিত করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এ দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীনকীর্তি, স্থাপনা বেহাত ও ধ্বংস হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সব ভবন ভেঙে নতুন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে বহুদিন থেকেই। এমনকি ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে যে ৯৩টি ভবন ও চারটি এলাকাকে হেরিটেজ (ঐতিহ্যবাহী) হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোও বাদ যাচ্ছে না ধ্বংসের হাত থেকে।

সম্প্রতি রোজার ঈদের বন্ধের মধ্যে পরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারে অবস্থিত জাহাজবাড়িটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মদদপুষ্ট একটি গ্রুপ।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে জানা গেছে, গত মার্চ থেকে জাহাজ বাড়ি ভাঙার চেষ্টা চলছিল। তখন জিডি করে থানার সাহায্যে ভাঙা বন্ধ করা হয়। এখন ঈদের ছুটিতে ভবনটি এমনভাবে ভাঙা হয়েছে, যেখানে এ কাজে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ভবনের যাঁরা ভাড়াটে ছিলেন তাঁরা বলছেন, এটি ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল। তাঁরা ওয়াকফ প্রশাসকের প্রতিনিধিকে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন তারা। এ ধরনের সম্পত্তি কীভাবে কারা ভাঙল, এ বিষয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। এ বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অন্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোও অরক্ষিত হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন একাধিক ব্যবসায়ী।

এদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

জানা গেছে, হাইকোর্ট ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০টি ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার ধ্বংস, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং সে তালিকায় জাহাজ বাড়িও রয়েছে। তারপরও আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভবনটি ভাঙা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত পুরনো ঢাকাসহ রাজধানীতে সহস্রাধিক কারুকাজ মণ্ডিত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। গত দশ বছরে বিনাশ করা হয়েছে আরো শতাধিক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ক্রমান্বয়ে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ঐতিহ্য বিনাশ রোধে সরকার তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

জানা গেছে, ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সরকার একাধিক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি হেরিটেজ কমিটি গঠন করে। কমিটি পুরনো ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত প্রাচীন ভবনগুলোকে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসির ভিতর শিব মন্দির, লালবাগ কেল্লা, জাতীয় তিন নেতার মাজার, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, শাহবাজ খান মসজিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রূপলাল হাউজ, ঢাকা ব্রাহ্মন সমাজ মন্দির, নবাব বাড়িসহ ৯৩টি ঐতিহ্যবাহী ভবনকে চূড়ান্তভাবে হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। তালিকাভুক্ত স্থাপনাগুলো দ্রুত সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা পাঠানো হলেও সংস্কারের ব্যাপারে এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে দুষ্টচক্রের কবলে পড়ে পুরাকীর্তিগুলো একে একে বেহাত ও ধ্বংস হচ্ছে।

হেরিটেজ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসা আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম বলেন, ২০১২ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে অবস্থিত ঢাকা জেলা কাউন্সিল ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৮ অক্টোবর হাই কোর্ট বেঞ্চ তিন মাসের মধ্যে হেরিটেজ স্থাপনা এবং এলাকার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং রাজউককে নির্দেশ দেয়। বেধে দেয়া সময় প্রায় আড়াই বছর আগে পার হয়ে গেলেও এখনো তৈরি করা হয়নি হেরিটেজ স্থাপত্যগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা। এদিকে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যু চক্র নির্বিচারে একের পর এক ঐতিহ্য ধ্বংস করে চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ সালে ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অবহেলাসহ নানা দুর্নীতির কারণে ঢাকার বুক থেকে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনকীর্তি বেহাত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে আছে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পুরাকীর্তি সংরক্ষণে প্রয়োজন নীতিমালা ও সমন্বিত উদ্যোগ। এজন্য পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ থাকতে হবে। দেশে পুরাকীর্তি রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু এ বাবদ মন্ত্রণালয়ে বাজেট দেয়া হয় সবচেয়ে কম। যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এসব বিষয়ে তাদের জ্ঞানের পরিধি নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের।

বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকেই জানেনই না এসব পুরাকীর্তি কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০০৮ সালের মে মাসে। ওই গেজেটে বিভিন্ন পুরাকীর্তি ছাড়া ব্যক্তিগত বাড়িঘর, স্থাপনা, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এলাকাগুলো হলো- ফরাশগঞ্জের ঋষিকেশ দাস রোড, রেবতীমোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড ও ফরাশগঞ্জ রোড, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, পানিতলা, সূত্রাপুরের প্যারিদাস রোড ও হেমেন্দ্র দাস রোড এবং রমনার বেইলি রোড, মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ও পার্ক এভিনিউ। পাশাপাশি এবিষয়ে রাজউকের বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেয়া হয়, তালিকাভুক্ত ভবন, স্থাপনা ও এলাকায় বিদ্যমান ভবন ও কাঠামো নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ব্যতীত আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নিমাণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করা যাবে না। অপরদিকে স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতিকে প্রধান করে গঠিত কমিটি পুরাকীর্তির এই সংরক্ষিত তালিকা প্রকাশ করে। কমিটিতে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, গণপূর্ত অধিদফতর, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রতিনিধি। এ বিষয়ে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বর্তমান সরকার পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না। কেন না তালিকা করা বা আইন করাই যথেষ্ট নয়। শুধু আইন করে পুরাকীর্তি রক্ষা করা যায় না। ড. মুনতাসীর মামুন আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে সব কাজ ঝুলে যায়। ফলে সংস্কার বা সংরক্ষণের আগেই বেহাত হয়ে গেছে ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত পুরাকীর্তি। এ কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুরাকীর্তিগুলো রক্ষা করাও কঠিন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের পক্ষে যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে সব ধ্বংস ও দখল হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের।

এইচএম/আরআই