• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০১৯, ১০:০৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৭, ২০১৯, ১০:১১ পিএম

ঢাকা শহরে ভয়াবহ যত অগ্নিকাণ্ড

পরিষ্কার নয় কারণ, বছরের পর বছর ঝুলছে চার্জশিট

পরিষ্কার নয় কারণ, বছরের পর বছর ঝুলছে চার্জশিট
এফ আর টাওয়ারে আগুন-ছবি : কাশেম হারুন

রাজধানীর পল্লবীর কালশি ট্র্যাজেডিসহ বেশ কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার চার্জশিট হয়নি দীর্ঘদিনেও। মামলার তদন্ত হাত বদলের সাথে সাথে চার্জশিট ঝুলছে বছরের পর বছর। আর এসব ঘটনার আগুনের সূত্রপাতও পরিষ্কার নয়। পুলিশের দায়ের করা মামলাতেও উঠে আসে না অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ। উপেক্ষিত থেকেই যায় আগুনে সব হারানো মানুষের অভিযোগ ও ঘটনার যোগসূত্র। অগ্নিকাণ্ডে কারা লাভবান হন বা হয়েছেন, সে বিষয়টিও আমলে নেয়া হয় না কখনই। সব কিছুর সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে যান ক্ষমতাধররা।

রাজধানীতে সংঘটিত ভয়াবহ কয়েকটি আগুনের ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে দৈনিক জাগরণ এর অনুসন্ধানে।  

বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ২৮ মার্চ। এ ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৭০ জন। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমান এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৬ ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনা নিয়ে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলেও কেবল আমলে নেয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের উল্লেখ করা শর্টসার্কিটের বিষয়টি।

এ ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ৭০ জন মানুষ। এতদিন পরেও নেই সে ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি।

২০১৮ সালের ১২ মার্চ রাজধানীর পল্লবীতে সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার নামে স্থাপিত এক বস্তিতে আগুন লেগে বস্তির প্রায় ৫ হাজার ঘর ও মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনায় দুই দিন পর পল্লবী থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হলেও এখনও ঝুলছে এর চার্জশিট।

২০১৭ সালের ১৫ মার্চ গভীর রাত ২টা ৫০ মিনিটের দিকে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় কাউকেই আসামি করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাতের বিষয়টিকেই পুলিশও প্রাধান্য দেয়। অথচ কোটি কোটি টাকা মূল্যের এ জমি নিয়ে দু’টি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলে আসছিল। তারা বস্তির লোকদের বহুবার উচ্ছেদের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও পুলিশ অজ্ঞাত কারণে তা আমলে নেয় নি। এখনও দেয়া হয় নি এ মামলার চার্জশিট। 

২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরে গুলশানের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন-ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটটির বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করে মার্কেটটি চালু করা হয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ভোরে আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে মার্কেটের কাঁচাবাজারের পূর্ব পাশে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

দৈনিক জাগরণ এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহুতল ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে এখানকার ব্যবসায়ীদের এ জায়গা খালি করে দেয়ার হুমকি-ধামকির মধ্যেই প্রথমবার ২০১৭ সালে এখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কমিটি আগুনের সূত্রপাত হিসেবে উল্লেখ করে শর্টসার্কিট। পুলিশের মামলাও সেদিকেই প্রবাহিত হয়। দেয়া হয়নি চার্জশিট। পরবর্তীতে একইভাবে আগুন লাগে এ বছরের ৩০ মার্চ।

২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের পাশে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন বস্তিতে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১ জন। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় মামলা হলেও দেয়া হয়নি চার্জশিট। আমলে নেয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা শর্টসার্কিটের বিষয়টিই। অথচ এই বস্তির জমি উচ্ছেদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে  বিরোধ চলছিল। এ ব্যাপারে বস্তিবাসীদের অভিযোগ আমলে নেয় নি তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগেও ২০১৬ সালে ৫ অক্টোবর হাজারীবাগের বউবাজার বস্তিতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৫০টি ঘর।

২০১৪ সালের ১৪ জুন রাজধানীর পল্লবীর কালশিতে বিহারি ক্যাম্প বস্তির একটি ঘরের দরজায় তালা দিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে একই পরিবারের ৯ জন এবং গুলিতে ১ জনসহ ১০ জনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) এখনও দেয়া হয়নি। এর আগে মূল অভিযুক্ত স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং তার সহকর্মীদের নাম বাদ দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হয়।পরিবারের ৯ সদস্য হারানো ইয়াসিন ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দেন। পরে এ মামলাটি নতুন করে সিআইডিকে তদন্ত-ভার দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই থেকেই চলছে তদন্ত কার্যক্রম।  

শবেবরাত উপলক্ষে ভোর রাতে আতশবাজি ফোটানোকে কেন্দ্র করে ফজরের নামাজের পর রাজু বস্তি ও বিহারি ক্যাম্পের লোকদের মাঝে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পাশে আগে থেকে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উভয় পক্ষকে ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়েও দেয়। একপর্যায়ে সেখানে বিপুল পুলিশের সমাগম ঘটে। সংঘর্ষের প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ একটি রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর শতাধিক নেতা-কর্মী ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন পুলিশ গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পের ‘আই’ ব্লকের মোহাম্মদ ইয়াসিনের ঘরে কেরোসিন ঢেলে দরজায় তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ইয়াসিন বেঁচে গেলেও তার পরিবারের ৯ সদস্য আগুনে পুড়ে মারা যান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিহারি ক্যাম্পের এ হত্যাযজ্ঞের ৩ দিন আগে বিহারি ক্যাম্পে এসে অপমানিত হয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। তখন তিনি সবাইকে দেখে নেবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় ক্ষমতাধর সবাই থেকে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

২০১২ সালে ২৪ নভেম্বর তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন নিহত হন। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাজরিনের মালিকসহ কর্মকর্তাদের আসামি করে মামলা দায়ের করে পুলিশ। এ মামলার সব আসামিরা এখন জামিনে আছেন।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন নারী ও শিশুসহ ১২৪ জন। নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টায় ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর একদিন পর পুলিশের দায়ের করা এ মামলার চার্জশিট দেয়া হলেও এ মামলার অভিযুক্তরা সবাই এখন জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান

এসব বিষয়ে জানতে প্রশ্ন করা হয় ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমানকে। তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগ মামলার বাদী হিসেবে কাউকে পাওয়া যায় না। যে কারণেই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। তদন্ত রিপোর্টের ক্ষেত্রেও পুলিশকে সহায়তা করে ফায়ার সার্ভিস। সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ই সংশ্লিষ্টরা তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশকে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যে নির্ভর করতে হয়। কালশিসহ অনেক মামলায় ভিডিও দেখে আসামিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে শিগগিরই তারা গ্রেফতার হবে বলে দাবি করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ছবি কাশেম হারুন ও সংগৃহীত

এমএএম/আরআই/এসএমএম

আরও পড়ুন