• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯, ১২:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯, ১২:৪২ পিএম

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ‘কাউয়া’দের মধ্যে আতঙ্ক

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ‘কাউয়া’দের মধ্যে আতঙ্ক
খালেদ মাহমুদ ভুইয়া, জি কে শামীম ও লোকমান হোসেন ভুইয়া

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে র‌্যাবের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে একের পর এক অবৈধ ক্যাসিনো, মাদক আখড়া ও জুয়াড়িদের ক্লাব উদ্ঘাটন হচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জুয়া-ক্যাসিনো ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলটি। ফলে অবৈধ সুবিধা নিতে অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী এসব   ‘কাউয়া’ নেতাদের মধ্যে বর্তমানে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে এসব অভিযোগে চিহ্নিত ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুরুর দিনই আটক করা হয়েছে ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুইয়াসহ বেশ কয়েকজনকে। পরদিন রাজধানীর গুলশান নিকেতন থেকে র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন যু্বলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক দেশে  ‘টেন্ডার কিং’ হিসেবে পরিচিত জিকে শামীমসহ আরও কয়েকজন। এদের আটক করার সময় কোটি কোটি নগদ টাকা, মদ ও অন্যান্য মাদকসহ বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। 
     
আইনশঙ্খলা বাহিনীর এ অভিযানে দেশে এই মুহুর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুবলীগ। শীর্ষ দুইনেতার গ্রেফতারের পর মিডিয়ার শিরোনাম এখন সংগঠনটি। বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অপকর্ম এখন মানুষের মুখে মুখে। সংগঠনের আত্মসমালোচনার বাইরে দায় এড়াতে আসছে অনু্প্রবেশের প্রশ্ন। আর এতেই সাপ খুঁজতে কেঁচো বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা। ফেঁসে যাচ্ছেন বহু রথি মহারথি।

ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
 
২০১৭ সালের ২২ মার্চ সিলেটে দলীয় এক কর্মসূচিতে ওবায়দুল কাদের সংগঠনে ‘কাউয়া’ (কাক) তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। ওইদিন তিনি বলেন, দলে কাউয়া ঢুকছে। প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশাজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।

এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেলেও এসব কাউয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত কোন অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি ক্ষমতাসীনদের। 

খালেদ মাহমুদ ভুইয়া, জিকে শামীম, মোহামেডানের অন্যতম পরিচালক লোকমান হোসেন ভুইয়াসহ আরও কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর এসব ‘কাউয়া’দের মধ্যে রীতিমত আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 
 
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে দলে অনুপ্রবেশের বিষয়টি তারা স্বীকার করেন। পাশাপাশি তারা বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় রাজনৈতিক দল। টানা তিনবারের মত দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। সেক্ষেত্রে সুবিধা নিতে ও সুবিধা নেয়ার টার্গেট নিয়ে অনেকেই দলে ভিড়েছে । সবকিছু সব সময় ঠেকানো যায় না। তবে, আরও আগে থেকেই এসব অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে সাংগঠনিকভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত ছিল।  

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শেখ ফজলুল হক মণির প্রতিষ্ঠিত যুবলীগকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী অপরাধীচক্র। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতা ও অর্থের মূল কেন্দ্রে এই চক্র। নামে বেনামে টাকার পাহাড় গড়েছে এই অসাধু চক্র। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শক্ত এ চক্রের ভিত। শেখ মণির ঐতিহ্যবাহী যুবলীগ এসব অপরাধীদের সাইনবোর্ড মাত্র।

ইতোমধ্যে এদের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক রকম ভড়কে যাওয়ার মতো অবস্থা। যার কারণে চরম ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী সংগঠনের ইমেজ ফেরাতে ও সামাজিক অসঙ্গতি দূর করতে শুদ্ধি অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি মূল দল আওয়ামী লীগের ভেতরেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন নেতাদের। 

প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরপরই ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ক্লাব ক্যাসিনোগুলো অভিযানে চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে মাদক ও অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া যায়, অপরাধ জগতে যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। ওদিনই গুলশানের বাসা থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর একে একে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গার ক্লাবেও হানা দেয় র‌্যাব।

২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাজধানীর নিকেতনে নিজ অফিস থেকে গ্রেফতার হন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় সম্পাদক জি কে শামীম। খালেদ-শামীমের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডের দেয়া তথ্যের বরাতে নানা গল্প আসছে মিডিয়ায়।

এদিকে, যুবলীগের এই দুই নেতার গ্রেফতারে পুরো ক্ষমতাসীন শিবিরে শুরু হয়েছে তোলপাড়। আতঙ্কে বহু নেতা। তার মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়িও থেমে নেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের। এতে বেরিয়ে এসেছে অনুপ্রবেশের তথ্য। এ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে-কীভাবে অনুপ্রবেশ হয়েছে, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কারা এই নেটওয়ার্কে জড়িত, এদের মূল নিয়ন্ত্রক বা আশ্রয়দাতা কে বা কারা? 

যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তৎকালীন যুবলীগ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগে পদ পান। তার স্থলে একই বছরের ২৪ জুলাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেব দায়িত্ব পান মো. ওমর ফারুক চৌধুরী। এরপর ২০১২ সালের ১৪ জুলাই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পূর্ণ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান তিনি। সাধারণ সম্পাদক হন হারুনুর রশীদ। একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ১৩৭ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন তারা। তিন বছরের মধ্যে সবগুলো ইউনিটে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দিয়ে কেন্দ্রের সম্মেলনে নতুন নেতৃত্বের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা ছিল তাদের। কিন্তু চেয়ারম্যানের ১০ বছর আর সম্মেলনের ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সম্মেলন হয়নি সংগঠনটির। শাখা সম্মেলনেও আগ্রহ নেই নেতাদের। বরং কেন্দ্রীয় কমিটি রিশাফল হয়েছে বার বার। টাকায় পদ পাওয়া এখানে ওপেনসিক্রেট। আর এই সুযোগটিই নিয়েছেন অপরাধী চক্রটি। আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যানের ডান হাত খ্যাত দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান।

এদিকে, ক্যাসিনো পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা প্রায় সবাই যুবলীগ-আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলে দাবি করা হচ্ছে। কাকতালীয়ভাবেই হোক আর নির্দিষ্ট টার্গেট করেই হোক এসব গুরুতর অভিযোগে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়াদের অধিকাংশই দলে অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই পরিচিত। সে কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সকল অঙ্গ সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী নেতাদের মধ্যে বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে চরম আতঙ্ক। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে তারা বিভিন্ন সময় অন্যদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব দলের এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে ছিলেন তারা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান পাল্টাতে থাকেন। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে রোজগার করা কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন।

সূত্র জানায়, ঢাকায় ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত রাজধানীর সাত নেতা এসেছেন ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি (এরশাদ) থেকে। এদের হাত ধরেই প্রথমে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া, পরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনোর প্রসার ঘটে। এরমধ্যে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, সমবায় সম্পাদক জি কে শামীম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ (কালা ফিরোজ) এবং মোহামেডান ক্লাবের লোকমান হোসেন ভুইয়া। এর মধ্যে চারজনকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে, বাকিরা এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে। এছাড়া অপর নেতা হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এসেছেন যুবদল থেকে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) হয়ে আওয়ামী লীগে।

সূত্র জানায়, আলোচিত ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটও ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তার রাজনীতি যুবলীগ থেকে শুরু প্রচার হলেও এক সময় তিনি যুবদলের নেতাদের সঙ্গে চলতেন বলে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের আদি বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায়। তার বাবা চাকরি করতেন রাজউকে। যুবলীগে সম্রাটের রাজনীতি শুরু হয় ১৯৯১ সালে। তার আগে যুবদল নেতাদের সঙ্গে তার চলাচল ছিল। মূলত রাজধানীর মতিঝিল থানার বিভিন্ন এলাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলোয় জুয়ার আসরকে ক্যাসিনোতে উন্নীত করার মূল উদ্যোক্তা হলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এদিকে, শুক্রবার রাজধানীর নিকেতন থেকে আটক জি কে শামীমও আগে যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের (চরভুলুয়া গ্রামের) দক্ষিণপাড়ার মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে জি কে শামীম। বর্তমানে তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক। আটকের পর থেকে তিনি দেশে ‘টেন্ডার কিং’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। যুবদল নেতা জি কে শামীম লেখাপড়া শেষে ঠিকাদারি শুরু করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার খুবই ঘনিষ্ঠ। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীনই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য ধরে রাখতে ভোল পাল্টিয়ে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতে থাকেন।

অভিযোগ আছে, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ বিএনপির এক নেতার ক্যাডার থেকে হয়ে যান আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। চারজনকে হত্যাসহ তার বিরুদ্ধে নানা তথ্য বের হয়ে আসছে। র‌্যাবের করা দুই মামলায় কালা ফিরোজ মোট ১০ দিন রিমান্ডে আছেন। ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন ফিরোজ। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বায়রার সিনিয়র সহ-সভাপতি ফিরোজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি কলাবাগানে ৩০ কাঠার প্লট দখলে নিয়েছেন। পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নির্মাণ কাজ দুই বছর বন্ধ রাখেন ফিরোজ। পরে বোঝাপড়া হওয়ার পর নির্মাণ কাজ চালু হয়।

মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক আরমানের রাজনীতি শুরুও বিএনপি দিয়ে। নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে লাগেজ ব্যবসা করতেন। একসময় বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেনের (বাউন্ডারী ইকবাল) ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ইকবালের যাতায়াত ছিল হাওয়া ভবনে। তার মাধ্যমে আরমানও শামিল হন বিএনপির রাজনীতিতে। পদ-পদবি না থাকলেও হাওয়া ভবনঘনিষ্ঠ বলে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। বিএনপি আমলেই আরমান ফকিরাপুলের কয়েকটি ক্লাবের জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে যুবলীগের মিছিলে অংশ নিতে শুরু করেন আরমান। ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সম্রাটের। সম্রাট ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হলে সহসভাপতি করা হয় আরমানকে। সম্রাটের ক্যাসিনোর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আরমান। আরমান শত শত কোটি টাকার মালিক এখন। 

মোমিনুল হক সাঈদ মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি হন বিএনপি নেতা লোকমান হোসেন ভুইয়া। লোকমান হোসেনের ক্যাডার হিসেবে বিএনপির রাজনীতিতে আগমন ঘটে সাঈদের। মতিঝিল এলাকার ভয়ংকর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাঈদ হঠাৎ যুবলীগ হয়ে ওঠেন বিএনপি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পরপরই। দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকার ক্যাসিনো জগতের অন্যতম মাফিয়া সাইদ। তার নিয়ন্ত্রিত ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে নগদ ১০ লাখ টাকা জব্দ করেছে র‌্যাব। তিনি আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেরও সভাপতি। 

যুবলীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার রাজনীতির শুরু ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রবাজ ক্যাডার হিসেবে। ১৯৮৭ সালে খিলগাঁওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মানিক ও মুরাদের মাধ্যমে ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ক্যাডারের পরিচিতি পান। পরে সম্রাটের মাধ্যমে যোগ দেন যুবলীগে। যুবলীগে আসা খালেদের টার্গেটে পরিণত হন এলাকার নিবেদিত আওয়ামী পরিবারের সদস্যরা। মোহাম্মদপুরে যুবলীগ নেতা গিয়াসসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতা খুনের পেছনে খালেদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবির পরিচালক এক সময়ে বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপির আলোচিত-সমালোচিত নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর ঘনিষ্ঠ সহচর এই লোকমান ভূইয়া। পরবর্তীতে মোহামেডান ক্লাবের ক্ষমতা নিয়ে ফালুর সঙ্গে লোকমান ভুইয়ার দূরত্ব তৈরি হয়। ২০০৮ সালে লোকমানকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রকাশ্য হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে বিসিবির চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপনের ঘনিষ্টজন হয়ে উঠেন। মূলত সেই থেকেই তার উত্থান ঘটতে থাকে।

এদিকে, জুয়া-ক্যাসিনোর পক্ষে সংবিধান লঙ্ঘন করে জোরালো বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ চট্টগ্রামের পটিয়ার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি বিচ্ছু সামসু নামে পরিচিত। জাতীয় সংসদের এই হুইপও ক্ষমতাসীন দলে ‘কাউয়া’ মধ্যে অন্যতম এতজন বলে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। জানা যায়, সামসুল হক চৌধুরী এক সময় ডবলমুরিং থানা যুবদলের সেক্রেটারি ছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) রাজনীতিও করেছেন।
 
সম্প্রতি জুয়া-ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর একজন পুলিশ পরিদর্শক তার বিরুদ্ধে ১৮০ কোটি টাকা চট্টগ্রামের একটি ক্লাবের জুয়া থেকে আয় করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। এমপি সামসু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি তাকে বরখাস্তও করা হয়েছে। 

এদিকে আওয়ামী লীগের হুইপ বহুল বিতর্কিত শামসুলের ছেলে শারুন ও চট্টগ্রাম আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রবীণ নেতা দিদারুল আলমের টেলিফোন কথোপকথনের অডিও রেকর্ড ফাঁস হলে দেশজুড়ে ঝড় ওঠে। শামসুলের ছেলে শারুন দিদারুল আলম চৌধুরীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও রাস্তায় নগ্ন করে পেটানোর যে হুমকি দিয়েছেন তাতে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। সবাই বলছেন, বিএনপি ও স্বৈরাচার এরশাদের দল করে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলা করা আজকের আওয়ামী লীগের হুইপ শামসুল হক ক্ষমতার দম্ভে এতটাই উন্নাসিক যে তার ছেলে শারুন আরও বেশি বেপরোয়া বলেই দলের ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ একজন বয়স্ক নেতার সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মহানগর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী বলেন, পটিয়ার আওয়ামী লীগের এমপি শামসুল হক চৌধুরী একসময় ডবলমুরিং থানা যুবদলের সেক্রেটারি ছিলেন। পরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিও করেন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে আসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এ সময় উপস্থিত অন্যদের ধরে নির্বাচনি প্রচারণার মাইক হাতে নেন শামসুল হক চৌধুরী। জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে লাগামহীনভাবে গালাগালি করায় সেদিন জিয়াউর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন শামসুল হক। সেদিন তার ‘বিচ্ছু শামসু’ নামটি জিয়াউর রহমান দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ডবলমুরিং থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় তিনটি টাইপ মেশিন চুরি করে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন শামসুল হক চৌধুরী। এ ঘটনায় ১৭ দিন হাজতবাসও করেন। পরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামী লীগের মিটিং পন্ড  করার জন্য বোমা হামলা চালান দলবল নিয়ে। তখন আমাদের মোশাররফ ভাই আহত হয়েছিলেন। 

টিএস/বিএস 

আরও পড়ুন