• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০, ১০:৩০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০, ১০:৩০ এএম

রাজধানীজুড়ে মশার উৎপাত বাড়ছে, মানুষের মনে ডেঙ্গু আতঙ্ক

রাজধানীজুড়ে মশার উৎপাত বাড়ছে,  মানুষের মনে ডেঙ্গু আতঙ্ক
ছবি- সংগৃহীত

চীনের উহান শহর থেকে ক্রমেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এরইমধ্যে আফ্রিকায় লাসলা ফিভার ও ব্রাজিলে সন্ধান মিলেছে 'ইয়ারা' ভাইরাস নামের আরেক প্রাণঘাতী ভাইরাসের। সারা বিশ্বের বুকে যখন এমন একের পর এক মরণব্যাধির সংক্রমণ বিস্তার লাভ করছে, ঠিক সে সময় রাজধানী ঢাকার বুকে মশার উপদ্রব বৃদ্ধিতে রীতিমত আতঙ্কিত নগরবাসী। কারণ মাত্র গেল বছরেই রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথাই ফিরে ফিরে আসছে মামুষের মনে।

শীতের প্রকোপ কমতে না কমতেই বাড়তে শুরু করেছে মশার উপদ্রব। গত বছর এতগুলো মানুষের মৃত্যুর পর এ বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস আর নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের হিড়িক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দমে যায়। সিটি নির্বাচন নিয়ে ভরপুর নির্বাচনী উত্তেজনা থাকলেও নগরবাসীর এই এডিস ভীতি দূরীকরণে নজরে আসছে না কোনো তৎপরতা।

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার কার্যকর পদক্ষেপের নির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও প্রতিটি সংকটে করি করছি করে যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় কোনো কাজে, সময়ের আগে কেন সে সব বিষয়ে সচেতনতা আসে না- নগরবাসীর এই একটাই প্রশ্ন।

গত বছর মার্চের শেষদিকে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সে সময় নানা পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, জেলায় জেলায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কেবল সরকারি হিসেবেই মারা যায় ১৬৬ জন। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী ভর্তি হয়; উপায়ান্তর না পেয়ে মেঝে, বারান্দায় বা হাসপাতালের ফাঁকা স্থানগুলোয়ও ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য শয্যা পাতা হয়। সে সময় ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ছাড়াও ছিল আক্রান্তদের ওষুধের সংকট।

বেশ কয়েক মাস এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পর ডেঙ্গুজ্বরের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসে। গত নভেম্বরের শেষদিকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অনেকটাই কমে এলে থমকে যায় সব উদ্যোগ। একপর্যায়ে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চাপা পড়ে যায় ডেঙ্গুজ্বরের বিষয়টি। এর সঙ্গে সঙ্গে মশক নিধন কার্যক্রমও কমতে কমতে একপর্যায়ে থমকে যায়। কিছুদিন ধরে রাজধানীজুড়ে ফের চরমে পৌঁছেছে  মশার উৎপাত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন থেকে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো বন্ধ আছে। চলছে না মশার প্রজনন রোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানও। আর যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তা এক্ষেত্রে নানা প্রত্যাশা পূরণের মত ধোঁয়াশা। যা মশাদের সামান্য ভয় দেখাতেও ব্যর্থ।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে অন্তত ২১৯ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসার পর হাসপাতাল ছেড়েছেন ২০৯ জন। এ সময়কালে ডেঙ্গু-আক্রান্ত কারও মৃত্যুর দুঃসংবাদ পাওয়া যায়নি। তবেপ্রকোপ যে শুরু হবার পথে মশারা তার আগাম বার্তা জানান দিয়ে গেছে ঠিকই।  রাজধানীর ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে ৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রায় নিয়মিতই মশার ওষুধ অন্তত ছিটানো হতো। কিন্তু গত দুমাস ধরে তাও বন্ধ আছে। এরই মধ্যে মশার উৎপাত ফের অনেকটাই বেড়ে গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ওয়ার্ডগুলোতে এরইমধ্যে মশার উৎপাত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। এরমাঝে নতুন ওয়ার্ডগুলোর অধিকাংশই তুরাগ নদ ও সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি বদ্ধ জলাশয়্রর সন্নিকটে হওয়ায় সেসব স্থানে উপদ্রব কিছুটা বেশি বলেই জানা গেছে। তবে আক্ষেপ করে অনেকেই বলেছেন, নেতাদের শুভেচ্ছা বিনিময়ই এখনো শেষ হয়নি। আর ভোট দেয়ার পর তো নাগরিকদের কাছে এমন কোনো ইস্যুই থাকে না যার জন্য তাদের নিয়ে মাথাব্যথা করতে হবে!

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে ৩৬টি ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডের অবস্থা খুবই নাজুক। এর অধিকাংশগুলোতেই মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো মশককর্মী নেই; নেই পরিচ্ছন্নতা কর্মীও। ফলে এসব ওয়ার্ডে মশার যন্ত্রণাও বেশি। 
তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম হিসেবে কেবল উত্তর সিটির ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তায় দুই বেলা মশার স্মোক মেশিন সম্বলিত মটরবাইক ছুটতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে কয়েকটি ছোট ছোট বদ্ধ জলাশয় ভরাটের কাজ শুরুর প্রস্তুতিও নজরে এসেছে। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মাঝে তৎপরতা শুরুর প্রচেষ্টা চাল্লিয়ে যাওয়া এই ওয়ার্ডের পুনঃনির্বাচীত কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ জানান, গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই তার এই তৎপরতা শুরুর চেষ্টা। তবে সবাই এখনই একযোগে কাজে না নামলে এই চেষ্টার কোনো লাভ নেই। তাই অতিদ্রুত সবাইকে তৎপরভাবে কাজ শুরুর আহ্বানও জানান তিনি। 
গত বছরের ডেঙ্গু প্রকোপের সময় এই এলাকা থেকে একজন রোগিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হননি বলেই জানিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। তবে এটি একটি ওয়ার্ডের কাজ নয় তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুরু না করা হলে দুর্ভোগে পড়তে হবে সবাইকে, এমনটাই ধারনা তাদের।
ঢাকা উত্তরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুল্লাহ রায়হান বলেন, এ ওয়ার্ডে কখনই মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। দিনের বেলায়ও মশার কামড়ে বাসায় থাকা দায় হয়ে পড়েছে।

শীত শেষেই শুরু হবে মশার প্রাদুর্ভাব কাল। গত বছরের মার্চের শেষের দিকে এর প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও চলতি বছরের শুরুতেই দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। এছাড়া কীটতত্ত্ববিদরাও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি।


তবে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুনের বক্তব্যে মিলছে আশ্বাস। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন যে, আমরা গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এখন জানি কোথায় এডিস মশার বংশবিস্তার, কোথায় ঘনত্ব বেশি, কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় ইত্যাদি। তাই এসব তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে আমরা বছরের শুরু থেকেই পুরোদমে কাজে নেমেছি।

অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণের সিটি কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, মশা নিধনে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি নতুন নানা কার্যক্রমও হাতে নেয়া হয়েছে। মশক কর্মী, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা হয়েছে। সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নগরবাসীর প্রশ্ন হলো, সবই তো হচ্ছে তবে কি যে হচ্ছে তার বাস্তবতা সন্ধ্যা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে। তাদের দাবি, আশ্বাস দিয়ে যেহেতু মশা নিরোধন হবে না সেহেতু মানুষকে আশ্বাস না দিয়ে মশাদের কিছু দেয়া হোক যাতে উপদ্রব হ্রাস হয় আর সিটি করপোরেশনের তৎপরতা চলছে- সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয়।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় এডিস মশার পরিমাণ বেশি। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার জরিপেও রাজধানীর অন্তত ত্রিশটি স্থানে মশার ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে নতুন মেয়রদের পাশাপাশি প্রতিটি এলাকার কাউন্সিলরদের প্রধান কাজ হবে, এসব স্থানগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পুরো রাজধানীতেই মশার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ওয়ার্ডভিত্তিক এডিস মশা নিধনে টিম গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিচ্ছন্ন সিটি গড়ার কার্যক্রমে যুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করা। জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক হলে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ একযোগে কাজ করবে বলেই বিশেষজ্ঞের বিশ্বাস।