• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২১, ০২:৫০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৫, ২০২১, ১০:৩২ পিএম

উত্তর সিটিতে লোডশেডিং

চলছে দিন-রাত, বিদ্যুৎ বিভ্রাট

চলছে দিন-রাত, বিদ্যুৎ বিভ্রাট

শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন দেশের প্রতিটি প্রান্তে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সেবা প্রদানের কথা বলা হচ্ছে ঠিক তখনই দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত খোদ রাজধানী। ঢাকা দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন এলাকায় চলমান এই সমস্যার সমাধান নিশ্চিত না হতেই এবার একই ভোগান্তিতে পড়েছেন উত্তর সিটির মানুষ। বিশেষ করে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নবগঠিত ওয়ার্ডগুলোতে এই সমস্যা চরমে বলে জানা গেছে। দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা এই সমস্যার সমাধান পাওয়া তো দূর, সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যোগাযোগ করলে অধিকাংশ সময় সাড়াই পাওয়া যায় না। এমনটাই অভিযোগ করেছেন ডিএনসিসি ৫৩ ও ৫৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।

বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখেই অর্থ দিতে হচ্ছে। তারপরও থেমে নেই লোডশেডিং। খোদ রাজধানীতেই এলাকাভেদে দিনে দু-তিনবার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে। সেই ভোগান্তির মুখে এখন অতিষ্ঠ উত্তর সিটির বেশ কয়েকটি এলাকা। তাদের অভিযোগ- যান্ত্রিক ত্রুটি বা উন্নয়নের কাজ চলছে বলা হয়। কিন্তু আগাম নোটিশ দেয়া হয় না। ত্রুটি থাকলে এলাকায় কাজও করতে দেখি না। তবে প্রায়ই শোনা যায় সরবরাহে ঘাটতির কথা। সেক্ষেত্রে বলার কিছু থাকে না অবশ্য। কিন্তু এই ত্রুটি-বিচ্যুতির সমস্যা প্রতিদিনই থাকছে, সেটা আসলে কতটা সত্য এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সাধারণের।

উল্লেখ্য, গত ২৩ ও ২৪ আগস্ট এই প্রতিবেদনের সরেজমিন অনুসন্ধানকালে এলাকাটিতে অন্তত চার দফা লোডশেডিংয়ের নজির দেখেছে জাগরণ টিম।

এদিকে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুত সরবরাহের স্বল্পতার কথা বলা হলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে একেবারে ভিন্ন তথ্য। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে চলতি মাসের ১০ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ, যোগান ও চাহিদা সম্পৃক্ত তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় - এ সময়ের মধ্যে অত্র অঞ্চলে চাহিদার তুলোনায় বিদ্যুতের যোগান ছিল পর্যাপ্ত। যার প্রেক্ষিতে লোডশেডিংয়ের হার উল্লেখ রয়েছে একেবারে শূন্যের কোঠায়। তারমধ্যে সর্বশেষ উল্লেখিত ২৩ আগস্টের সামগ্রিক তথ্য বলছে, এদিন শুধু ঢাকা নয় বরং দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত এবং লোডশেডিংয়ের মাত্রা ছিল শূন্য। সেক্ষেত্রে নগরবাসী প্রতিদিন কেন বিদ্যুৎ বিভ্রাট পোহাচ্ছে তার ভুতুড়ে কারণ বোঝা দুষ্কর। আর যাদের কাছে এর প্রকৃত উত্তর রয়েছে, অজ্ঞাত কারণে তারা নিশ্চুপ।

১০-২৩ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চাহিদা সংক্রান্ত  বিপিডিবি'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য

উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর সংলগ্ন ৫৪ নং ওয়ার্ডের কামারপাড়া, রানাভোলাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় এই সমস্যার কথা জানা গেছে। কামারপাড়ার এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে এই সমস্যা। ফোন দিলে সাড়া পাওয়া যায় না। জানতে চাইলেই বলে উন্নয়নের কাজ চলছে। উন্নয়নের কাজ চলছে, তবে উন্নতির লক্ষণ তো দেখি না।

এলাকার আরেক বাসিন্দা মোঃ রিয়াজ শাহী দৈনিক জাগরণকে বলেন, বিদ্যুৎখাতের উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের সাফল্য নজিরবিহ্যিন। সরকার তো দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নয়নে কোনো কমতি রাখেননি। তারপরেও এই ভোগান্তি। যা পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ করে যে, বিদ্যুতসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গ্রাহকদের এই ভোগান্তির দায় মূলত বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ও সেবাপ্রদানকারী সেক্টরের অব্যবস্থাপনা। এতে করে শুধু জনদুর্ভোগই হচ্ছে না, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার পরেও সরকারের প্রচেষ্টা কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। যা খুবই বিব্রতর। কারণ দিনশেষে সাধারণ মানুষের বিবেচনায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই হয়। তাই তাদের কার্যক্রম ও অভিযোগের ক্ষেত্রগুলো সমাধানে সরকার আরো কঠোর হবে বলে প্রত্যাশা করি।

গ্রাহকদের ডাকে সাড়া না দেয়ার প্রসঙ্গে এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, নিয়মানুসারে সংস্কার বা উন্নয়নমূলক কাজ করা হলে তা অগ্রিম অবগত করার নিয়ম। কিন্তু এতদিনে তো তেমন কোনো মাইকিং বা ঘোষণা শুনলাম না। দিনভর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে বিদ্যুতের আসা যাওয়া না। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর রীতিমত অসহ্য হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মাত্রা। রাতেও এমন চলে কিন্তু ফোন করলে আর কাউকে পাওয়া যায়। কিছু বললেই জানাবে, যান্ত্রিক ত্রুটি। কিন্তু দফায় দফায় বিদ্যুতের বিল বাড়ানো বা ভুতুড়ে বিলের কাণ্ড ঘটানোর সময় তো কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি হয় না। শুধু সেবা দিতে গেলেই যত সমস্যা।

সিটির নতুন বাজার এলাকার এক প্রবীন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, রাত-বিরাতে বিদ্যুতের সমস্যায় পড়তে হয়। তখন ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে একটা ভয়াবহ ব্যাপার আছে। শুধু লোডশেডিং না অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটলেও কিন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে তাদের এই গ্রাহকের কলে সাড়া না দেয়াটা কত ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে তা কি উনারা বোঝেন?

উত্তর সিটির বেড়িবাঁধ এলাকার এক অভিভাবক জানান, অনেক অপেক্ষার পর বাচ্চাদের বোর্ড পরীক্ষার সুযোগ এসেছে। প্রস্তুতি নিয়ে তাদের পরীক্ষায় বসতে হবে। তাছাড়া রয়েছে এসাইনমেন্টের কাজ। বিদ্যুতের এই যখন তখন বিনা নোটিশে আসা-যাওয়া সেক্ষেত্রে চরম সমস্যার। বার বার অভিযোগ করার পরেও স্থায়ী সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না।

একই এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা মানে পানিরও সমস্যা। ফ্রিজে রাখা কাচামাল সংরক্ষণে সমস্যা। সব মিলিয়ে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়া লাগে প্রতিদিনই।

রানাভোলা এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, বিদ্যুৎ যাওয়ার কোনো সময় নেই। দিনেও যায় আবার গভীর রাতেও যায়। কখনও ঘণ্টা পেরিয়ে বিদ্যুৎ আসে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে এসেছে সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে। রাত ১২টার পর আবার লোডশেডিং। যদিও তখন ২০ মিনিট স্থায়ী ছিল। এভাবে প্রতিদিনই দু-তিনবার করে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলে। তাদের কাছে জানতে চাইলে এমনভাবে উত্তর দেয় যেন বিনা পয়সায় সেবা দিচ্ছে এই বেশি।

কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বললে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের জিজ্ঞাসা- বলা হচ্ছে বিদ্যুতের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। তাহলে এভাবে লোডশেডিং হচ্ছে কেন? যখন গরম বেশি পড়ে তখন লোডশেডিং বেড়ে যায়। এতে ভোগান্তি বেশি হয়। তারা বলেন, ঢাকা শহর ঘনবসতিপূর্ণ। বাড়িঘর ঘিঞ্জি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে বাসায় টেকা মুশকিল হয়ে পড়ে।

আবু বখতিয়ার রহমান জাগরণকে বলেন, আগের চেয়ে বিদ্যুতের ভোগান্তি কমেছে। কিন্তু একবারে নাই হয়ে যায়নি। বিশেষ করে যেদিন গরম পড়ে, সেদিন লোডশেডিং বেশ ভোগায়। বিদ্যুতের চেয়ে বেশি ভোগায় সংশ্লিষ্টদের আচরণ আর অবিবেচকের মতো করা কাজগুলো।

এদিকে গ্রাহকদে অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুত সরবরাহ ও গ্রাহকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অফিসে বা কন্ট্রোলরুমে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কারো সাড়া পাওয়া যায়নি। কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নম্বরে কল করলেও ফলাফল একই ছিল।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে দেশে লোডশেডিং নেই। অথচ দফায় দফায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অতিষ্ট উত্তর সিটির বাসিন্দারা। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গত কয়েকদিনের বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ ও যোগেনের পরিসংখ্যান যাচাইয়ে উত্তর সিটির এই এলাকায় লোডশেডিং হবার মতো পরিস্থিতি নজরে পড়েনি। সেক্ষেত্রে কেন এই বিভ্রাট, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে। কিন্তু বারংবার চেষ্টা করে অত্র এলাকার  ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের মতো সংশ্লিষ্টদের নাগাল পায়নি দৈনিক জাগরণও।