• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০১৯, ০৪:০৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৮, ২০১৯, ০৪:০৭ পিএম

কার্গো পরিবহনে স্থবিরতা

লন্ডনে কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে ডুবছে বিমান! 

লন্ডনে কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে ডুবছে বিমান! 
লন্ডনে বাংলাদেশ বিমানের অফিস - ছবি : জাগরণ

বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন অফিসের দুর্নীতির তদন্তকে প্রভাবিত করতে চলছে নানা কৌশল। দুর্নীতির দায়ে মূল অভিযুক্তরা নিজেদের বাঁচাতে অন্যদের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে বিভ্রান্ত করতে নানা অবাস্তব ও কাল্পনিক অভিযোগ তোলা হচ্ছে।  

উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার কৌশলের খেলায় মূল হোতারা পার পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। গত দুদিনে সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। আর এক্ষেত্রে বিমানে পণ্য পরিবহনকারী কয়েকটি কার্গো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পুঁজি করে নাম ভাঙানো হচ্ছে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার। 
গত দুদিনে লন্ডনে কয়েকটি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ট্রাভেল এজেন্ট ও বিমানের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

সম্প্রতি বিমানের কার্গো পরিবহন খাতে ৪১২ কোটি টাকা অনিয়ম তদন্তের সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসছে একের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য। এতে জড়িয়ে পড়েছেন বিমানের লন্ডন স্টেশনের সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লন্ডনে বিমান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সামনে বিমান বাংলাদেশের লন্ডন অফিসের সাবেক ফাইন্যান্স ম্যানেজার প্রিয়রঞ্জন মহাজনের কর্তব্যে অবহেলা, ঘুষ চাওয়াসহ অনিয়মের নানা বিষয় ধামাচাপা দিতে একটি পক্ষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাজানো হচ্ছে একের পর মিথ্যা অভিযোগ। ভুল তথ্য দিয়ে বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার মতো অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল, যার মূলে রয়েছেন সাবেক এই কর্মকর্তা।

সূত্র আরো জানায়, ২০১৬ সালে বিমানের লন্ডন অফিসের ফাইন্যান্স ম্যানেজার হয়ে আসার কথা ছিলো ফাহিমা হকের। তবে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সেবছর জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে সুকৌশলে লন্ডনের এই পদটি বাগিয়ে নেন প্রিয়রঞ্জন মহাজন। লন্ডন অফিসে যোগ দিয়েই প্রকাশ্যে একের পর এক নানা অনিয়মে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। ছোট-বড় নানা অভিযোগ জমা হতে থাকে তার বিরুদ্ধে। 

জানা যায়, প্রিয়রঞ্জন মহাজনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগটি ধরা পড়ে ২০১৭ সালের শেষের দিকে। বিমানের পাইলট ও কেবিন ক্রুদের থাকার জন্য চুক্তি ছিল সেন্ট্রাল লন্ডনের সেন্ট গিলস হোটেলের সঙ্গে। সেই চুক্তি শেষ হয়ে গেলে হোটেলের ই-মেইল এড্রেস এর নকল আরো একটি ই-মেইল এড্রেস বানিয়ে বিমানের লন্ডন অফিসে চূড়ান্ত বিল প্রদান করেন এই প্রিয়রঞ্জন মহাজন। লন্ডন স্টেশন ম্যানেজারের বরাবরে প্রায় ১০ হাজার পাউন্ডের এই বিল পরিশোধের জন্য হোটেলের একাউন্ট হিসেবে দেখান নিজের ব্যক্তিগত একটি ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কায়দায় ই-মেইলের মাধ্যমে করা এই বিল জালিয়াতির বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে বিমানের লন্ডন অফিসের কর্মকর্তা মাহমুদা তালুকদারের কাছে। তখন প্রিয়রঞ্জন মহাজন নিজ দায়িত্বেই দ্রুত এই বিল প্রসেসিং করেন। পুরো ঘটনা গোপন রেখে তৎকালীন সদ্যনিয়োগ পাওয়া কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে সেকেন্ড অথরাইজড স্বাক্ষর আদায় করে নেন তিনি। পরবর্তীতে বিষয়টি তৎকালীন ইউকে কান্ট্রি ম্যানেজারের কাছে ধরা পড়লে এই বিষয়ে বিমানের প্রধান কার্যালয়কে অবগত করেন তিনি। তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রিয়রঞ্জন মহাজনের বিল জালিয়াতির বিষয়টি। সেই থেকেই নানাভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

মেয়াদ শেষে শফিকুল ইসলাম ঢাকায় ফিরে এলে তার পদোন্নতি ঠেকাতে নানা তৎপরতা শুরু করেন প্রিয়রঞ্জন মহাজন। শফিকুলের বিরুদ্ধে ফ্রি টিকেট কেলেংকারিসহ মনগড়া নানা অনিয়ম সাজিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নামে-বেনামে অভিযোগ দেয়া হয়। আর সেসব অভিযোগের ভিত্তিতেই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি।

জানা যায়, বিমানের অফিসিয়াল নিয়ম অনুযায়ী প্যাসেঞ্জার সেলস এজেন্টস (পিএসএ)ভুক্ত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে নিয়মিত বার্ষিক সেলস ইনসেনটিভ দেয়া হয়ে থাকে। আর এই ইনসেনটিভ নেয়ার সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে ফাইন্যান্স ম্যানেজার প্রিয়রঞ্জন মহাজনকে দিতে হতো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, তা না হলে নানা অজুহাতে বিলম্ব হতো এই ইনসেনটিভ প্রাপ্তি। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ না দিলে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে পোহাতে হতো নানা ভোগান্তি।

ওপেন সিক্রেট এই বিষয়টিতে ক্ষুদ্ধ ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ীরা বিমানের তৎকালীন পরিচালক এন আই খানের কাছে স্বয়ং প্রিয়রঞ্জন মহাজনের সামনেই অভিযোগ তুলে ধরেন।

জানা যায়, ঘুষের টাকা না পেয়ে প্রিয়রঞ্জন মহাজনের রোষানলের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন আটকে থাকে লন্ডন-ঢাকা রুটের বিমানের কার্গো সেলস এজেন্টস জেএমজি কার্গোর ইনসেনটিভ। এ বিষয়ে জেএমজি কার্গোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরাসরি বিমানের তৎকালীন পরিচালক এন আই খানের কাছে অভিযোগ করলে তিনি তা আমলে নিয়ে তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে দীর্ঘদিন পর বিমানের সঙ্গে ২২ অক্টোবর ২০১৩ তারিখের লিখিত শর্তানুযায়ী দুই বছরের ন্যায্য ইনসেনটিভ গত ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ জেএমজি কার্গোকে চেকের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ইউকে অফিস। 

এরপর থেকেই প্রিয়রঞ্জন মহাজনের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হতে হয় জেএমজি কার্গোকে। এই খ্যাতনামা কার্গোর বিরুদ্ধে বিমানসহ নানা দপ্তরে নামে-বেনামে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রিয়রঞ্জন মহাজনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সহযোগিতা না করায় রোষানলে পড়তে হয়েছে বিমানের সদ্য সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামকে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রাণলয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে শফিকুল ইসলামকে জড়িয়ে নানা অপপ্রচার ও অভিযোগ দায়ের করে। এমনকী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে জেএমজি কার্গোর অবাস্তব ব্যবসায়িক সম্পর্ক সাজিয়ে নানা অভিযোগ দায়ের করেন।

জানা যায়, বিমানের আয়ের এই কার্গো সেক্টর বর্তমানে চলে যাচ্ছে অন্যান্য বিদেশি এয়ারলাইন্সের হাতে। ঢালাওভাবে আনা নানা ভিত্তিহীন অভিযোগে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে লন্ডনে কার্গো ব্যবসায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।

লন্ডনের একটি কার্গো হ্যান্ডেলিং প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে কর্মরত শাহরাজ হোসাইন বলেন,  লন্ডনে বিমানের প্যাসেঞ্জার ও কার্গো হ্যান্ডেলিং এজেন্ট বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘ডানাটা’। যারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সূক্ষ্ম পরিমাপ ও সর্বোচ্চ সিকিউরিটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কার্গো হ্যান্ডেলিং করে থাকে। এসময় ডানাটা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে তিন ধাপে কার্গো পরিমাপ করে। এরপর ডানাটার দেয়া পরিমাপের উপরই বিমান বাংলাদেশ তার কার্গো এজেন্টদের বিল প্রদানের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। যেখানে কোনো প্রকার ন্যূনতম কারচুপি হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগও নেই বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সার্টিফাইড একাউন্টেন্ট আবুল হায়াত নুরুজ্জামান বলেন, স্বাভাবিক নিয়মেই বিমান বাংলাদেশ এর যুক্তরাজ্য অফিসের আর্থিক সব লেনদেন প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অডিট হওয়ার কথা। তৎকালীন কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের কর্মরত সময়কালীন চার বছরের এতসব অনিয়ম অডিট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নজরে না আসার বিষয়টিও অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি।

সাবেক এই দুই কর্মকর্তার দ্বন্দ্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিমানের লন্ডন রুটের টিকিট ও কার্গো বিক্রয় সেবা। নানা মুখরোচক কাহিনী এখন পরিণত হয়েছে টক অব দ্য কমিউনিটিতে। যার কারণে বিমানের দীর্ঘদিনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বিমানের প্রতি এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান কমিউনিটি নেতা আব্দুল করিম গণি।

স্থানীয় কার্গো ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান জানান, সম্ভাবনাময় কার্গো সেক্টরে বর্তমানে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কার্গো ব্যবসায়ীরা জটিলতা এড়িয়ে চলতে বিমানের পরিবর্তে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে কার্গো পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে। আর এই সুযোগে কার্গোর দাম প্রতিযোগিতামূলকভাবে কমিয়ে স্থান দখল করে নিচ্ছে সৌদি এয়ার, গালফ এয়ারের মতো বিশ্বখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলো। বিমানের এজেন্টদের মাধ্যমে তৈরি হওয়া দীর্ঘদিনের এই সেক্টরটি বেহাত হতে বসেছে। যার ফলে বিমান হারাচ্ছে মোটা অংকের আয়ের উৎস। এভাবে চলতে থাকলে লন্ডন-ঢাকা রুটে কার্গো পরিবহণের হার শূন্যে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, কার্গো পরিবহনে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম। এছাড়া ঢাকা-সিলেটের মধ্যে ঢাকার দূরত্ব বেশি হলেও বিমানের কার্গো পরিবহনে ঢাকার ভাড়া সিলেটের চেয়ে কম।

পিক সিজনে লন্ডন-সিলেট রুটে ভাড়া ১১০০ থেকে ১২০০ পাউন্ড রাখা হয়। বছরের হলিডে সিজনে এমন আকাশচুম্বি ভাড়া না রেখে তুলনামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া রাখা হলে সারাবছর জুড়ে যাত্রী পেত বিমান। সেক্ষেত্রে সিট খালি থাকত না।

এফসি