• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০১৯, ১০:০০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৮, ২০১৯, ১০:১০ পিএম

মুনাফার জন্য রেল চালায় না সরকার

মুনাফার জন্য রেল চালায় না সরকার
নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে চলছে রেল-সংগৃহীত

পরিচালনা খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও পদে পদে দুর্নীতি

কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীরা টিকিট কাটছে না বা কাটতে চাইছে না

পণ্য পরিবহনে আয় নেমে এসেছে যাত্রী পরিবহনের ৪ ভাগের ১ ভাগে

রেলে যুক্ত হচ্ছে আরও ৬০টি কোচ বা বগি 

● লোকবল বাড়িয়ে সমস্যা-সঙ্কট দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ করে শক্ত হাতে পরিচালনা করলে বাংলাদেশ রেলওয়েকে লাভজনক খাতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তবে এর উল্টো কথা বলছেন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন। তিনি মন্তব্য করে বলেছেন, সরকার দেশের মানুষের সেবা দেয়ার জন্য রেল চালায়, মুনাফার জন্য চালায় না। রেলের ভাড়া ইচ্ছে করলেই বাড়াতে পারি না।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ৯ বছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮) রেলওয়ে খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এ সময়কালে পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি। আয় হয়েছে ৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। বিপরীতে লোকসান গুণতে হয়েছে ৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া না গেলেও এ বছর লোকসানের মাত্রা ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রেল খাতে ১২ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের র‌্যাংকিংয়ে ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর অবস্থান ছিল ১৪২টি দেশের মধ্যে ৭৩তম।

সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালে ১৪০টি দেশের মধ্যে ৬০তম স্থানে চলে এসেছে দেশের রেল অবকাঠামো। এ সময় রেলের সার্বিক স্কোরও ২ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৯৪ (৭-এর মধ্যে)।

অবকাঠামো উন্নয়নে র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির পাশাপাশি আয়ও বাড়ছে রেলওয়ে খাতে। 

জানা গেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ রেলওয়ে খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে রেলে অনুন্নয়ন (পরিচালনা) ব্যয়ের চেয়ে উন্নয়ন খাতে (প্রকল্প বাস্তবায়ন) বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সেই হিসেবে গত ৯ অর্থবছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮) রেলের পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। তারমধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। আর পরিচালনা খাতে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। বাকিটা ব্যয় হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে।

আয়-ব্যয়-লোকসানের চিত্র

রেলওয়ের অর্থ শাখার দেয়া তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলের আয় ৫৮৪ কোটি টাকা, পরিচালনা খাতে ব্যয় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা এবং লোকসান গুণতে হয়েছে ৭৫৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে আয় ৬১৭ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা ও লোকসান ৯৫৮ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় ৬২৯ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ও লোকসান ১০৫০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ৮০৪ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ও লোকসান ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় ৯৩১ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ও লোকসান ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় ৯৫৬ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ১ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ও লোকসান ৮৭১ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ও  লোকসান ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা ও লোকসান ১ কোটি ২২৬ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, পরিচালনা ব্যয় ২ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ও লোকসান ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। 

প্রাপ্ত এ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখলে দেখা যাবে, প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান দিচ্ছে রেল এবং সেটা ক্রমে ক্রমেই বেড়েই চলছে। রেল খাতের ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে বর্তমান সরকারের আমলে দুই দফায় রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া ৭ থেকে ৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালেও বাড়ানো হয়েছিল ভাড়া।

লোকসানের মূল কারণ অব্যবস্থাপনা ও পদে পদে দুর্নীতি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেল সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেলের ধারাবাহিক লোকসানের মূল কারণ হচ্ছে পরিচালনা খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও পদে পদে দুর্নীতি।

ওই কর্মকর্তারা জানান, রেল এখন বিপুলসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করে থাকে। এখন যাত্রীদের টিকিট কাটার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যাত্রীরা টিকিট কাটছে না বা কাটতে চাইছে না। তার মূল কারণ কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যাত্রীদের সাথে অবৈধ যোগসাজস। বিশেষ করে রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার আগে যাত্রীদের সাথে রফাদফা করে রেলওয়ে বিভাগে একটি চক্র। এই সক্রিয় চক্রটিকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব এবং লাভের মুখ দেখবে রেলওয়ে। সে সঙ্গে বাড়বে সেবার মান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একশ্রেণির যাত্রী আছেন যারা মূল ভাড়া না দিয়ে টিটি কিংবা রেল সংশ্লিষ্টদের সাথে কম টাকায় রফা-দফা করে যাতায়াত করেন। যদি সবাইকে টিকিট কাটতে বাধ্য করা হয়, তাহলে লোকসানের পরিমাণ কমে আসত। কিন্তু সেটা হয় নি বলেই গত ৯ বছরের লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলছে।

রেলওয়ে বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা। ব্যয় ১ টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতিটনে রেলের কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২২ পয়সা। তার বিপরীতে আয় ২ টাকা ৫ পয়সা।

এ থেকে দেখা যাচ্ছে, যাত্রী পরিবহনের চেয়ে ভালো আয় হয় পণ্য পরিবহনে। কিন্তু পণ্য পরিবহন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় মূলত রেলের লোকসানের বোঝা দিনকে দিন ভারি থেকে ভারিতর হচ্ছে।

রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, ২০০১-০২ অর্থবছরেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের আয় ছিল প্রায় সমান। ১৬ বছর পর পণ্য পরিবহনে আয় নেমে এসেছে যাত্রী পরিবহনের চার ভাগের এক ভাগে।

২০০২-০৩ অর্থবছরে রেল পরিবহন করে তিন কোটি ৯১ লাখ ৬২ হাজার যাত্রী। একই সময়ে পণ্য পরিবহন করে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টন। রেলে এখন যাত্রী প্রায় আট কোটি হলেও পণ্য পরিবহন কমে নেমেছে প্রায় ২৫ লাখ টনে। 

এক দশক আগেও দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যের ১২ শতাংশ রেলের মাধ্যমে পরিবহন করা হতো। এখন তা কমে পাঁচ শতাংশে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেলে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ার পাশাপাশি লোকসানের অন্যতম কারণ কোচ বা বগি, ওয়াগন ও ইঞ্জিন সঙ্কট। ২০১১ সালের আগের ১০ বছরে নতুন কোনও ইঞ্জিন কেনা হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের আমলে যাত্রীবাহী কোচ বা বগি কেনা হয়েছে ২৭০টি। পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয় ৪৪৬টি। ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি।

জানা গেছে, খুব শিগগিরই রেলে নতুন আরও ৬০টি কোচ বা বগি যুক্ত হবে। 

আধুনিক ও যুগোপযোগী উন্নয়ন করে সেবার মান বাড়ানো হবে : রেলমন্ত্রী

রেলের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা হয় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সাথে। তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় দেশের মানুষের সেবা দেয়ার জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে জনগণের সেবার জন্য সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতেও রেলকে আধুনিক ও যুগোপযোগী উন্নয়ন করে সেবার মান বাড়ানো হবে। মানুষকে কাঙ্খিত সেবা দেয়ার জন্য সরকার সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে লোকবল সঙ্কট রয়েছে। এ কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সেবা একেবারেই থেমে নেই। ভবিষ্যতে এ সঙ্কট আর থাকবে না। খুব দ্রুতই লোকবল বাড়িয়ে রেলের বিভিন্ন সমস্যা-সঙ্কট দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রেলে কোচ বা বগিগুলোকে পরিবেশবান্ধব করার ব্যবস্থা নিতে এরইমধ্যে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

টিএইচ/এসএমএম