• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১, ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

মোটরযান আইন ২০১৮

ডিএমপিতে পরীক্ষামূলকভাবে সর্বনিম্ন অর্থদণ্ডই প্রয়োগ করা হবে    

ডিএমপিতে পরীক্ষামূলকভাবে সর্বনিম্ন অর্থদণ্ডই প্রয়োগ করা হবে    
প্রাইভেটকারের কাগজ দেখছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট - ফাইল ছবি

নতুন মোটরযান আইন ২০১৮ এর অর্থদণ্ড নমনীয়ভাবে প্রয়োগ শুরু করে ধীরে ধীরে কঠোরতার দিকে অগ্রসরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। পুলিশের ভাষায়- নমনীয়তার মাধ্যমে সর্বনিম্ন অর্থদণ্ডের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। আইনে রয়েছে শুধুমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তির পরিমাণ। যা হঠাৎ করে বাস্তবায়ন অসম্ভব প্রায়। তাই আপাতত সর্বনিম্ন অর্থদণ্ড-ই প্রয়োগ করা হবে।

এসব বিষয় নিয়ে শনিবার (০২ নভেম্বর) ডিএমপির ট্রাফিক সদস্যদের ব্রিফিং করবেন ঊর্ধ্বতনরা। এরপর থেকেই প্রয়োগ শুরু।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী- শুক্রবার (০১ নভেম্বর) থেকে মোটরযান আইন ২০১৮ কার্যকর করা হয়েছে। তবে এই আইন বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি শুক্রবার। বন্ধ ছিল মামলা দেয়ার ইলেট্রনিক ডিভাইস পজ মেশিন। ফলে অন্যদিনের মতন মামলাও দেয়া হয়নি। অল্পকিছু যা-ও মামলা দেয়া হয়েছে, তা সনাতন পদ্ধতিতে স্লিপে কলমে লিখে দেয়া হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্পটে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট, ট্রাফিক ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদিও নতুন আইন প্রয়োগ নিয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে।

ডিএমপি ট্রাফিকের নমনীয়তা যেভাবে :-

এ সংক্রান্ত দুটি কাগজ এসেছে দৈনিক জাগরণের কাছে। এতে বলা আছে-

১. ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান ও গণপরিবহন চালালে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ৫ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ১০ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে ওই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাস কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

২. রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরযান চালালে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ২০ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৩. ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান চালালে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ২০ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাস কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৪. কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মোটরযানের আকার পরিবর্তন/হাইড্রলিক হর্ন/সিট বৃদ্ধি/সাইলেন্সার পাইপ পরিবর্তন/ইঞ্জিন পরিবর্তন করলে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১৫ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ৩০ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১ থেকে ৩ বছর কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৫. অতিরিক্ত ওজন বহন করলে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ২০ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১ বছর কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৬. মোটরযানের নির্দিষ্ট গতিসীমা লঙ্ঘন করলে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ২ হাজর ৫০০ টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ৫ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৭. পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়া বা এমন ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা/মিরর/লাইট/ভ্যান/রিক্সা/ নসিমনের জন্য শাস্তি দেয়া হবে ১৫০০ টাকা অর্থদণ্ড (ছোটগাড়ি), একই অপরাধের জন্য দ্বিতীয়বার করা হবে ৩ হাজার টাকা (ছোটগাড়ি)।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ মাস কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৮. মোটরযান চলাচলে সাধারণ নির্দেশাবলীর বিধান লঙ্ঘন করলে, যেমন- মদ্যপান করে চালনা, কন্ডাক্টর কর্তৃক চালনা, অবৈধ পার্কিং, উল্টোপথে চালনা, মোটর সাইকেলে ৩জন ও হেলমেটবিহীন অবস্থায় চালনা, চলন্ত অবস্থায় যাত্রী উঠানামা, বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও ফুটপাথে চালনা, প্রতিবন্ধী আসন না রাখা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, মালিকের অনুমতি ছাড়া চালনা, মিটারে না চলা, চালককে বিরক্ত করলে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ৩ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ৬ হাজার টাকা।

মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ২ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

৯. সিটবেল্ট না রাখা, খারাপ আচরণ করা, অতিরিক্ত যাত্রীবহন, সংরক্ষিত আসনে অন্য যাত্রীবহন করলে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ৩ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ৬ হাজার টাকা।

মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে প্রথমবার শাস্তি দেয়া হবে ১ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে এ দণ্ডের অঙ্ক হবে ২ হাজার টাকা।

আইনে বলা আছে- এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১ মাস কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

ট্রাফিক সদস্যদের প্রতি ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা:-

মাঠপর্যায়ে কর্মরত ট্রাফিক সদস্যরা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে নির্দেশনা আছে- প্রতিটি মামলা করার সময় যেন নিজেদের ভিডিও ক্যামেরা সচল করা থাকে। একদম সংশ্লিষ্ট অভিযোগে ধরা থেকে শুরু করে মামলা দেয়া পর্যন্ত পুরো চিত্র ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করতে হবে। কেননা, এবারের আইন অনুযায়ী- শাস্তির পরিমাণ পূর্বের আইনের চেয়ে বেশি। কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারীর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ দেন এবং দাবি করেন- অযথা বা বিনা অপরাধে মামলা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী যেন তা প্রমাণ করতে পারেন সেই ভিডিও ফুটেজ দিয়ে।

তবে এই পদ্ধতি নিয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন দৈনিক জাগরণের কাছে। তারা বলছেন- এই ফুটেজ তারা কতদিন সংরক্ষণ করবেন, কোথায় সংরক্ষণ করবেন? ব্যক্তি কবে, কখন সংক্ষুব্ধ হবেন- এর ঠিক নেই।

নির্দেশনা আরও আছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পার্কিং ও আংশিক উল্টোপথে চলাচলের ক্ষেত্রেও। সার্জেন্টরা জানান, ঊর্ধ্বতনরা বলেছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে বিআরটিএ থেকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, দীর্ঘ সময় লেগে যায়, মামলা করার সময় এ বিষয় খেয়াল রাখতে। অনেক সময় দেখা যেতে পারে, মোটরযান এমনস্থানে পার্কিং করা, যেটা অবৈধ পার্কিং এ পড়ে। তবে সেই পথে যানচলাচলে সমস্যা হচ্ছে না বা খুব কম হচ্ছে। সেগুলো নমনীয়ভাবে দেখতে বলা হয়েছে। আবার কিছু পথ আছে, যেগুলো চলতে খুব সামান্য উল্টোপথ চলা লাগতে পারে, সেক্ষেত্রেও কিছুটা নমনীয়তার পরিচয় দিতে বলা হয়েছে। এমন ছোট-খাটো আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো নমনীয়ভাবে দেখার নির্দেশনা আছে। রেকার বিল নির্ধারণের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান সার্জেন্টরা।

মামলা দেয়া শুরু হবে কাগজের ফরম দিয়ে:-

ডিএমপির ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানান, একদেড় মাস মামলা দেয়া হবে ছাপানো ফরম ফিলাপ করে। এই সময়ের মধ্যে সফওয়্যার আপডেট করা হবে। আপডেট শেষ হলে পূর্বের মতন পজ মেশিন দিয়ে মামলা দেয়া হবে।

নতুন আইনের ভীতি মোটরযান চালকদের মাঝে:-

গত সপ্তাহে সরকারের পক্ষ থেকে যখন ঘোষণা করা হয় যে, ১ নভেম্বর থেকে নতুন আইন কার্যকর করা হচ্ছে। তখন থেকেই এক ধরণের উদ্বেগ, আতংক ছড়িয়ে পড়ে মোটরযান চালকদের মাঝে। কেননা, নতুন আইনে শাস্তির পরিমাণ পূর্বের আইন থেকে অনেক বেশি। গণপরিবহন, ব্যক্তিপরিবহন- সব মোটরযান চালকদের মাঝেই ছিল উদ্বেগ, আতংক। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও বিভিন্ন পোস্ট দেখা গেছে। গণপরিবহনে ভীতি দেখা গেছে, কন্ডাক্টরের মাঝে বেশি। কেননা, নতুন আইন অনুযায়ী কন্ডাক্টরের কাজ করতে হলেও লাইসেন্স লাগবে। যা বর্তমানে কোনো কন্ডাক্টরের নেই বলে বিআরটিএ থেকে জানা গেছে। তাছাড়া লাইসেন্সবিহীন অনেক বাস চালক আজ শুক্রবার বাস চালাতে বের হননি। অন্যদিকে, লেগুনা, সিএনজি চালিত অটোরিকশার মতন পরিবহনগুলোও অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে শুক্রবার। তাছাড়া মোটর সাইকেল চালকদের মাঝেও লক্ষ্য করা গেছে, ব্যাপক ভীতি। তাদেরও অনেকে শুক্রবার বের হননি মোটর সাইকেল নিয়ে। কারও শিক্ষানবীশ ড্রাইভিং লাইসেন্স, কারও কোনো লাইসেন্সই নেই, কারও রেজিস্ট্রেশন সনদ, বীমা, ট্যাক্স টোকেন নেই বা মেয়াদ চলে গেছে। কারও মোটর সাইকেলে ফগ লাইট লাগানো, চোখ ধাঁধানো স্টিকার, হেডলাইট, উচ্চশব্দ যুক্ত সাইলেন্সারসহ অনেক কিছু প্রতিস্থাপন করা আছে। যা আইন পরিপন্থী।

শুক্রবার দুপুরে মানিক মিয়া এভিনিউজ ট্রাফিক বক্সে কর্তব্যরত ছিলেন সার্জেন্ট পলাশ। দৈনিক জাগরণের প্রশ্নে তিনি বলেন, নতুন আইন প্রয়োগ করার জন্য কোনো নির্দেশনা আজ ছিল না। আমরা আজকে মানুষকে সচেতন করেছি।

একই ধরণের মন্তব্য পাওয়া যায় আরও কিছু ট্রাফিক সার্জেন্টদের কাছ থেকেও।

আরএম/বিএস 
 

আরও পড়ুন