• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০১৯, ০৯:২৯ পিএম

অভয়াশ্রমে পাল্টে গেছে দেশি মাছের চিত্র

অভয়াশ্রমে পাল্টে গেছে দেশি মাছের চিত্র

 

নাটোরের হালতি বিল। নাটোর সদর এবং রলডাঙ্গা উপজেলায় এর অবস্থান। তবে এটা চলন বিলেরই একটি অংশ। এক সময় দেখা যায় এই বিলে মাছের সংকট। নির্বিচারে পোনা মাছ ও মা মাছ ধরা, সুতি ও কারেন্ট জালের ব্যবহার, শুষ্ক মৌসুমে বিলের জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের সংকট সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত নয় বছর বিলটি মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় পাল্টে যায় পুরো বিলের চিত্র। এখন এই বিলে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে ত্রিমোহিনীতে হালতি বিলে এখনো পানি রয়েছে। জেলেরা দলে দলে ছোট নৌকায় ভাগ হয়ে মাছ ধরছেন। বহু দিন পর জেলেদের মাছ ধরার এ চিত্র দেখা গেল বিলটিতে। মূলত অভয়াশ্রমই পাল্টে দিয়েছে বিগত দিনের চিত্রপট। এখন বিলটিতে পুঁটি, টেংরা, পাবদা, খয়রা, শৈল, বোয়াল, শিং, কৈ, মাগুর, ফলি, কাতল, রুই, মৃগেল, চিতল মাছে পরিপূর্ণ। আর স্থানীয় জেলেদের রোজগারের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বিলটি। পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাওয়ায় বাজারে মাছের দামও কমেছে। ফলে ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষ মাছের স্বাদ নিতে পারছেন। জেলেরা জানান, বিলে এখন প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়ায় তার দাম কমেছে। তবে দাম কমলেও তাদের পুঁসিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় এই হালতি বিলে মাছ কমে যেতে শুরু করে। ফলে স্থানীয় জেলেরা জীবন-জীবিকার সংকটে পড়েন। এ প্রশ্নে নাটোর সদর উপজেলার ধুলদহ, কামারদহ মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনসুর রহমান জানান, এক সময় হালতি বিলে মাছ কমে যাওয়ায় জেলেরা পড়ে বিপাকে। পরে মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করলে তারা হালতি বিলে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। সে অনুসারে ধুলদহ এবং কামারদহ নামক দুটি স্থানে আমরা মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলি। মাত্র দুই বছরে হালতি বিলে মাছের প্রার্চুয্য বেড়ে যায়। এখন জেলেরা অভয়াশ্রমটি নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে।

ত্রিমোহিনী থেকে নৌকায় নদীপথে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মরা আত্রাই নদীতে ধুলদহ এবং সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কামারদহ অভয়াশ্রম। এই অভয়াশ্রম ঘুরে দেখা যায়, নিরাপদ বসবাসের লক্ষ্যে সেখানে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন গাছের ডাল। পুঁতে দেওয়া হয়েছে বাঁশ। নৌকায় করে পাহারা দিচ্ছে জেলেরা।

হালতি বিলের করের গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী কথা প্রসঙ্গে জানান, এত মাছ গত ৪০ বছরে দেখা যায়নি। এ বছর এত মাছ পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আমরা সত্তর পূর্ববর্তী দশকে ফিরে গেছি। এ সবই সম্ভব হয়েছে হালতি ও চলনবিলে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য।

নলডাঙ্গা উপজেলার বামনমাঝ গ্রামের সেতু সংলগ্ন বালিরদহ অভয়াশ্রমের প্রবীণ মৎস্যজীবী মারফাত আলী জানান, জেলারা বিভিন্ন স্থানে অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে সত্যি। কিন্তু পাহারা না দিলে অভয়াশ্রম থেকে মাছ মেরে নেওয়ার ভয় রয়েছে। মৎস্যজীবী বৃন্দাবন দাস জানান, অভয়াশ্রামের কারণে তারা প্রচুর মাছ পাচ্ছেন। ফলে তাদের সংসার চালাতে এখন তেমন সমস্যা হচ্ছে না। অন্ত কুমার চন্দ্র জানান, মাছ পাওয়া গেলেও মহাজনের কারণে তারা অনেক সময় মাছ মারতে পারেন না। তছাড়া, প্রভাবশালী মহল নদী দখল করে মাছ মেরে নেয়। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো কার্যকরী ফল পাওয়া যায় না।

নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলোক কুমার জানান, নাটোরের বিভিন্ন নদী ও বিলে ২০টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিসহ দেশিয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এখন নাটোরে মাছের উৎপাদন বছরে গড় ৫০৯৯৭.০০ টন। যার মধ্যে উন্মুক্ত জলাশয়ের দেশিয় প্রজাতির মাছের পরিমাণ ১৫৭১১.০০ টন। জেলার চাহিদা রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৭৬ টন। ফলে জেলার চাহিদা মিটিয়ে গড় আট থেকে ১৩ হাজার ৬২০ টন মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।

মাছের প্রজনন বৃদ্ধির জন্য জেলায় অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় মৎস্য আবাহন পুনরুদ্ধারসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষে প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ, প্রকল্পের আওতায় ৭টি উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নে মোট ৭৫টি মৎস্য চাষ প্রদর্শনী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাছাড়া, জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় চারটি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়নে মোট ১৪৪টি মৎস্য চাষ প্রদর্শনী কার্যক্রম চলছে। কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ গবেষণা প্রকল্পের আওতায় বড়াইগ্রাম ও সিংড়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে মোট আটটি কুচিয়া চাষ প্রদর্শনী কার্যক্রম রয়েছে।

নাটোর নলডাঙ্গা উপজেলার বালিদহ, সিংড়া উপজেলার বারণই নদীতে দুটি, বড়াইগ্রাম উপজেলায় মরা বড়াল নদেতে চারটি, সিংড়া উপজেলায় আত্রাই নদীতে চারটি, গুরুদাসপুর উপজেলায় নন্দকুজা ও আত্রাই নদীতে দুটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া, নাটোরের পশ্চাৎপদ এলাকা হিসেবে সদর উপজেলার বারণই নদী ও টাংগীতে দুটি, বড়াইগ্রাম উপজেলার নগরে পাংগিয়ার দিঘি দুটি, খৈখোলা বিলে দুটি, মরা বরাল নদীতে দুটি, ছাতিয়ান গাছায় একটি, ডাঙ্গাদ্বারিকুশি একটি করে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। অভয়াশ্রম গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এসব অভয়াশ্রমে মা মাছ ডিম দেবে এবং মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে। এতে করে চলনবিল ও হালতি বিলে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

এসসি/