• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০১৯, ০২:২৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৩, ২০১৯, ০৫:৪৪ পিএম

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থেকে তোলা ছবি

সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণের কারণে ১০ জেলায় নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার ছিল ১২টি, শুক্রবার দেশের ১৪টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার (১৩ জুলাই) এসব পয়েন্টে পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। ফলে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, আগামী কয়েক দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে, তাতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

দৈনিক জাগরণ-এর সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর—

হবিগঞ্জ (নবীগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়ায় বাঁধ উপচে বেশ কয়েকটি গ্রামে প্রবেশ করছে পানি। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। 

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শনিবার (১৩জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টায় নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার সকাল ৯টা থেকে নবীগঞ্জের পারকুল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কুশিয়ারা ডাইকে মেরামতের কাজ পুনরায় শুরু করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড । 

পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এরই মধ্যে উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের দীঘলবাক, কসবা, কুমারকাঁদা, ফাদুল্লা,রাধাপুর, জামারগাঁওসহ বেশকিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। বসত ভিটায় পানি উঠায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাসিন্দারা। যে কোনও মুহূর্তে ওই ডাইক ভেঙে যেতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

কুশিয়ারা ডাইক ভেঙে গেলে প্লাবিত হতে পারে বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্ট- এমনটাও শঙ্কা প্রকাশ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

ডাইকে ভাঙন দেখা দিলে নবীগঞ্জের দীঘলবাক ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। পানি দিন দিন বৃদ্ধি হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন ওই এলাকার লোকজন। 

নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদ বিন হাসান জানান, সময় যত যাচ্ছে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকটি গ্রামে অল্প পানি প্রবেশ করেছে,বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে দীঘলবাক এলাকাসহ আশপাশ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে উপজেলায় একটি কন্ট্রোল রুম খুলেছি। জরুরি প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক হট লাইন নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারবেন পানিবন্দি লোকজন । 

হবিগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কুশিয়ারা ডাইকে মেরামতের জন্য আমাদের লোকজন কাজ করছে। ভাঙন রোধে এরই মধ্যে আমরা বস্তা ফেলে ভাঙন টেকাতে জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছি। 

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি নুন খাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাতে করে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, রাজারহাট ও নাগেশ্বরী উপজেলার নদ-নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, শাক-সবজিসহ আমন বীজতলা। 

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কিছু পরিবার ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও গরু ছাগল নিয়ে উঁচু সড়কে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন।

বন্যার্তদের জন্য এখন পর্যন্ত ত্রাণ তৎপরতা শুরু না হলেও জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানায়, বন্যার্তদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে বিতরণ শুরু হবে।

পাঁচগাছী সিতাইঝাড় এলাকার মোক্তার হোসেন (৪০), তাইজুল ইসলাম (৪৫) বলেন, আমাদের বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরাসহ গবাদি পশু নিয়ে খুবই দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি।

পাঁচগাছী ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন জানান, বিতরণের জন্য এখন পর্যন্ত ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া যায় নি। কিন্তু বন্যার্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ত্রাণ সামগ্রী পেলেই তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের বিতরণ করা হবে।  

মৌলভীবাজার সংবাদদাতা জানান, ভারতে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে মৌলভীবাজারের মনু নদী ও কমলগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে মনু ও ধলাই নদীর ৫৬টি প্রতিরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। বাঁধগুলো রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি গ্রামবাসীরা কাজ করছে।

জানা যায়, ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার, মনু নদীর কুলাউড়া অংশে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার এবং মৌলভীবাজার চাঁদনীঘাটে বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ২০ মিটার ভেঙ্গে কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকাসহ আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী তথ্যটি নিশ্চিত করে জানান, বৃষ্টি না হলে মনু নদীর নিন্মাঞ্চলে পানি বাড়বে। তবে বন্যা মোকাবিলায় আমরা তৎপর। এছাড়া জনসাধারণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বগুড়া সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের ফলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার চর এলাকার কামারপুর, রহদহ, ঘুঘুদহ, চন্দনবাইশা, ধলিরকান্দি ও কুতুবপুরের নিচু এলাকা ডুবে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, আমন বীজতলা ও  শাকসবজির খেত।  

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ জানান, যমুনার পানি সারিয়াকান্দি ও ধুনট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী সারিয়াকান্দির গোদখালী ও ধুনটের কয়াগাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাছাকাছি দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও বাঁধে ভাঙ্গনের কোন সম্ভাবনা নেই। যমুনার পানি নদী পারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যমুনার ভাঙ্গনও কমে গেছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ জানান, বন্যার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে নিয়ে সভা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ সামগ্রীও স্বল্প আকারে হলেও প্রস্তত রয়েছে। সার্বক্ষণিকভাবে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

নেত্রকোনা সংবাদদাতা জানান- ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দার প্রায় ১৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ৩ উপজেলায় অন্তত ২শ গ্রামে প্রায় ৫০ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি প্রবেশ করেছে ৫০শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বন্যার কারণে দুর্গাপুরে বিরিশিরি ও কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ১৯৬টি পরিবার স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামীণ বেশ কয়েকটি সড়ক পানির নিচে থাকায় উপজেলা ও জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত -ছবি : জাগরণ

সোমবার (৮ জুলাই) থেকে টানা ৪ দিনের মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাতে জেলার প্রধান নদী কংস, ধনু, উব্দাখালিতে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দার ৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়ন গুলো হল- বড়খাপন, রংছাতি, লেঙ্গুরা, খারনৈ, নাজিরপুর, পোগলা, কৈলাটি ও কলমাকান্দা সদর, দুর্গাপুরের গাওকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, বাকলজোড়া, কাকৈরগড়া ও বিরিশিরির আংশিক এলাকা এবং বারহাট্টার রায়পুর ও বাউসী ইউনিয়নের। তবে পাহাড়ি ঢলের পানি হঠাৎ এসে দ্রুত কমার ধারাবাহিকতায় পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী বিপদ সীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দুর্গাপুর উপজেলার পানি কমতে শুরু করেছে।

কলমাকান্দার পাঁচগাও, লেঙ্গুরা, বড়খাপন, চারালকোনাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ বাজার পানির নিচে রয়েছে। এছাড়া বড়খাপন, চানপুর, ধিতপুর, পাঁচকাঠা, পালপাড়া, কলেজ রোডসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ পাকা সড়ক পানির নিচে থাকায় মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ১৫০ পুকুর ও মৎস্য খামারে পানি প্রবেশ করে মাছ ভেসে গেছে। গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পানির তোড়ে শ্যামগঞ্জ- বিরিশিরি সড়কে ইন্দ্রপুর নামক স্থানে সেতু ও সড়ক ভাঙনের কবলে পড়েছে।

জামালপুর সংবাদদাতা জানান- টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। জেলার যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুরে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে -ছবি : জাগরণ

জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙে বন্যার পানি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পানি প্রবেশ করছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। হঠাৎ বন্যা আঘাত হানায় গরু ছাগল সহায় সম্পদ নিয়ে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটাছুটি করছে। আশ্রয় নিচ্ছে রেললাইনে, বাঁধে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও রাস্তারধারে উঁচুস্থানে।

জেলার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি, বেলগাছা, নোয়ারপাড়া,সাপধরি ও কুলকান্দি ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এছাড়াও মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।


এসএমএম/একেএস

আরও পড়ুন