• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০১৯, ০৭:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৫, ২০১৯, ০৭:৩৮ পিএম

রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর

বিপন্ন উখিয়া-টেকনাফ, উন্নীত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জীবনমান

বিপন্ন উখিয়া-টেকনাফ, উন্নীত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জীবনমান
২০১৭ সালের ২ অক্টোবর উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল  -  ফাইল ছবি

গত বুধবার (২১ আগস্ট) বিকেলে মালিক সাবের আহমদকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে তারই সামনে তার গৃহপালিত একটি মাঝারি গরু জবাই করে চামড়াটা রেখে সবকিছু নিয়ে যায় ৮-১০ জনের একদল রোহিঙ্গা। উখিয়া সদর থেকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের পাহাড়ি গহিন জঙ্গলে এ ঘটনা ঘটে।

এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই ক্যাম্পসংলগ্ন ও আশপাশ এলাকায় স্থানীয় লোকজন গবাদিপশু লালন-পালন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানান কুতুপালং এলাকার ইউপি মেম্বার বকতিয়ার আহমদ ও বালুখালী এলাকার আবসার মেম্বার।

মানবতার ডাকে নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে উখিয়া ও টেকনাফবাসীর জীবন চলছে করুণ অবস্থায়। অনেকেই বাস্তুভিটার অংশ, চাষাবাদের জমি হারিয়েছে। গত দুই বছরে শত শত একর আবাদি জমি রোহিঙ্গা বর্জ্যের কারণে খালি ফেলে রাখতে হচ্ছে।

সীমান্তবর্তী এই দুই উপজেলার ২৮টি পাহাড়ের ৩২টি আশ্রয়শিবিরে দুই লাখেরও বেশি ঝুপড়িতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। এর প্রভাব পড়েছে ক্রমেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। ওই অঞ্চলের উন্নয়ন হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তাঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের অধিবাসীদের।

দুই বছরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অনেক সুবিধা বেড়েছে  -  ফাইল ছবি

গত জুলাই মাসে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য ৩ শতাংশ বেড়েছে। গত দুই বছরে এ দুই উপজেলায় প্রায় আড়াই হাজার পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এর বাইরে আরো ১ হাজার ৩০০ পরিবার ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেখানে ৪৬৪ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঘর তৈরির জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা। একসময়ের সবুজ পাহাড় এখন বৃক্ষলতা-গুল্মশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে সেখানে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকিতে পড়েছে। পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের রান্নাবান্নার কাজে ৬ হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকেই ওই কাঠ সংগ্রহ করে।

কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লাহ কাটা এবং টেকনাফের চাকমারকুল, উনচিপ্রাং, লেদা, মৌচনী, জাদিমুড়া, শালবাগান ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেটভুক্ত প্রায় ৬ হাজার ১৬০ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে।

বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের এভাবে বসতি স্থাপনের কারণে টাকার হিসাবে সৃজিত এবং প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে বনজ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

শুধু বনভূমি বা জীববৈচিত্র্যই নয়, উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা বসতি মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কেও। ৭৯ কিলোমিটারের এই সড়কে স্থানীয় বাসিন্দাদের বহন করা গাড়ি এবং টেকনাফ স্থলবন্দরের নিয়মিত পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও অন্যান্য মালামাল বহনকারী শত শত ভারী যানবাহন যাতায়াত করছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অন্তত আড়াই শ গাড়িও এই সড়কে চলাচল করে। তাই সড়কে যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

অনাবাদি পড়ে রয়েছে স্থানীয়দের আবাদি জমি  -  ছবি : জাগরণ

কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘এটা সত্য যে রোহিঙ্গাদের কারণে ওই সড়ক এখন ব্যস্ততম সড়কে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত যানবাহন এখন এই সড়কে চলাচল করছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দারাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মানবতার খাতিরে যতটুকু সম্বল ছিল তা দিয়েই অসহায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছিল। আর গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) টেকনাফের জাদিমুড়া এলাকার যুবলীগ নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে সেই অকৃতজ্ঞ রোহিঙ্গাদের হাতেই।

রোহিঙ্গার সেই ঢল যে এত বড় ও দীর্ঘমেয়াদি হবে, সেটা ভাবতে পারেনি স্থানীয় বাসিন্দারা। সেদিন যারা মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল, আজ তারাই চরম দুর্দশা ও ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। অনেকের ফসলি জমি, বাড়ির উঠান পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা ফিরবে বা আদৌ তারা ফিরবে কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা। জানা গেছে, নতুন, পুরনো ও নবজাতক মিলিয়ে মিয়ানমারের ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৫৫৭ জন রোহিঙ্গার বসবাস এখন উখিয়া ও টেকনাফে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্যসচিব, উখিয়ার পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের হিংস্রতায় উখিয়া-টেকনাফের করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। যেভাবে রোহিঙ্গারা অনৈতিক আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে, তাতে আমরা স্থানীয়রা ভীতসন্ত্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে আছি।

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও প্রায় সার্বক্ষণিক নজরদারি ও পথেঘাটে তল্লাশির শিকার হয়ে রীতিমতো নাজেহাল হতে হচ্ছে বলে জানান সুজনের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার। রোহিঙ্গারা যাতে আশ্রয়শিবির ছেড়ে না পালাতে পারে, সে জন্য উখিয়া-টেকনাফ-কক্সবাজার প্রধান সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ সড়কে অন্তত সাতটি তল্লাশিচৌকি স্থাপন করেছে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেগুলোতে প্রতিনিয়ত তল্লাশির মুখে পড়তে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় শ্রমবাজারেও বড় প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গারা স্বল্প মজুরিতে শ্রম দিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাজের সুযোগ সংকুচিত করছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও নিবন্ধন কার্যক্রমের কারণেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। এ যেন রোহিঙ্গা আক্রান্তের পরিধি দিন দিন বাড়তেই থাকছে। এসব থেকে পরিত্রাণ চেয়ে কবে নাগাদ রোহিঙ্গামুক্ত বসবাস নিশ্চিত হবে, তা নিয়ে শঙ্কায় স্থানীয়রা।

এনআই

আরও পড়ুন