• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ০২:২৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ০২:২৯ পিএম

‘লামফি স্কিন ডিজিসে’ আক্রান্ত কালীগঞ্জের ২ শতাধিক গবাদি পশু 

‘লামফি স্কিন ডিজিসে’ আক্রান্ত কালীগঞ্জের ২ শতাধিক গবাদি পশু 

সংসারের শত অভাবের মধ্য দিয়েও কৃষাণী মোমেনা বেগম কষ্ট করে ১টি গাভী পালন করছেন। গাভীটি গত ৮ মাস আগে ১টি ষাঁড় বাছুর জন্ম দিয়েছিল। সন্তানের মত লালন পালন করে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তরতাজা ষাঁড় বাছুরটি সকলের নজর কেড়েছে। এই বাছুরটির মাধ্যমেই অভাব দূর করার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্ত গত কয়েক দিন আগে এর একটি পা ফুলে জ্বর এসে পরে সারা শরীরে বসন্তের মত গোল গোল চাক বের হয়েছে। এখন কোন কিছুই খাচ্ছে না। ফলে বাছুরটি ক্রমেই রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। 

একই গ্রামের সুফিয়া বেগমও ২টি দেশি জাতের গরু পালন করছেন। সংসারের টানাটানির মধ্যেও গরু দুটি বিক্রি করেননি। তার আশা ছিল আরও বড় করে বেশি দামে বিক্রির মাধ্যমে বেশি টাকা আয় করবেন। কিন্ত এত যত্নে পালিত একটি গরুর সপ্তাহ খানেক আগে দেখলেন পেটের উপরে গোল করে ফোসকা ওঠে গর্ত হয়ে পঁচন ধরেছে। যা দেখলে ভয় লাগছে। অনেক টাকার ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে কিন্ত ভালোর কোন লক্ষণ নেই। 

শুধু মোমেনা ও সুফিয়া একার নয়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সব এলাকাতেই  ছড়িয়ে পড়েছে গরুর এ রোগ। আক্রান্ত গরুগুলোর প্রথমে পা ফুলে যাচ্ছে। এরপর শরীরে জ্বর আসার ২/৩ দিন পরেই শরীরে বসন্তের মত গুটি গুটি ফোসকা বের হচ্ছে। স্থানীয় পশু চিকিৎসকেরা বলছেন, এটি এক জাতীয় মশার কামড়ে এ রোগের উৎপত্তি হচ্ছে। আক্রান্ত গরুগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় কৃষকেরা তাদের গোয়ালের গরুগুলো নিয়ে পড়েছেন মহা চিন্তায়। 

উপজেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর বলছে এ রোগ মরণব্যাধি নয়। এতে গবাদিপশু দুর্বল হয়ে পড়লেও কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হলে সুস্থ হয়ে ওঠে। ভুক্তভোগী গরুর খামারিদের অভিযোগ, এ উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন না থাকায় তাদের গবাদিপশুর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।  

উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের সবগুলোতেই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পূর্বাঞ্চালের নিয়ামতপুর, মালিয়াট, জামাল ও কোলা ইউনিয়নে এর প্রাদুর্ভাবটা বেশি দেখা যাচ্ছে। সরেজমিনে এ এলাকাটিতে গেলে দেখা যায়, কৃষকদের গোয়ালের হালের বলদ, দুধের গাভী, সদ্যজাত বাছুর সব বয়সী গরুই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত গরুগুলোর পা ফুলে গেছে এবং সারা শরীরের বসন্তের মত গুটি গুটি ফোসকা বের হয়েছে। আক্রান্ত গরুগুলো ঝিম ধরে রয়েছে। কোন কিছুই তেমন একটা খেতে চাচ্ছে না। এভাবে থেকে ক্রমেই শুকিয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। 

উপজেলার পারখালকুলা গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেনের ফ্রিজিয়ান জাতের একটি দুধের গাভীর পেছনের একটি পা ফুলেছে আর সারা শরীরে বসন্তের মত গুটি গুটি বের হয়েছে। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ওই গ্রামের ইমারত মন্ডলের ২টি গরুর। শুধু এ গ্রামেই নয় উপজেলার ডাউটি, হরদেবপুর, বাগডাঙ্গা, উল্যা, তালিয়ান, কাবিলপুর, বাসুদেবপুর, হুদাডাউটি, কোলা ইউনিয়নের বড়বায়সা, চুকাইতলা, খেদাপাড়া, রামচন্দ্রপুর, খালকুলা, মায়াধরপুর, কোলা, কাদিরডাঙ্গা, কামালহাট, খড়িকাডাঙ্গা ও দৌলতপুর গ্রামের দু’শতাধিক গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। 

উপজেলার ডাউটি গ্রামের কৃষক লিখন তরফদার জানান, তার হালচাষের ৩টি বড় বলদের অবস্থা বেশ খারাপ। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন কিন্ত সুস্থ হচ্ছে না। তালিয়ান গ্রামের নারায়ণ বিশ্বাস জানান, তার গোয়ালের মোট ৪টি গরুর পা ফুলে গায়ে ফুসকা বের হয়েছে। তার একটি বড় বলদের অবস্থা খুবই খারাপ। পায়ের ফোলা স্থানে ক্ষত হয়ে পঁচন ধরেছে। ক্ষতস্থানটির মাংস পঁচে গর্ত হয়ে গেছে। এ  গরুটির জন্যই প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে কিন্ত এখনও সুস্থ হয়নি। 

ডাউটি গ্রামের কৃষক মনিরুল ইসলাম, খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের আতিয়ার রহমান ও বড় বায়সা গ্রামের সত্যেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রতিটি কৃষক পরিবারেই গরু আছে। গবাদিপশু তারা নিজেদের সন্তানের মত করে লালন পালন করেন। কিন্ত অসুস্থ হয়ে গেলে উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে গিয়ে মানসম্মত সেবা পাচ্ছেন না। কেননা এখানে কোন ভেটেরিনারি সার্জন নেই। শুনেছি উনি নাকি ঝিনাইদহে বসেন। গবাদিপশু নিয়ে বাড়ি থেকে এতো দুরের পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে যাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাদের দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়টি দেখবেন। 

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতিকুজ্জামান জানান, এ রোগটি উপজেলার প্রায় সকল গ্রামেই কমবেশি দেখা দিয়েছে। রোগটির নাম ‘লামফি স্কিন ডিজিস’। তিনি বলেন, এটা হলে গবাদিপশুর পা ফুলে শরীরে জ্বরসহ বসন্তের মত চাক চাক হয়ে ফোসকা উঠতে পারে। তবে এটা কোন ক্রমেই মরণব্যাধি নয়। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, তিনি খবর পেয়ে উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে গিয়ে দেখেছেন। ব্যবস্থাপত্র দেয়া গবাদি পশুগুলো ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। 

জেলা প্রাণীসম্পদ অফিসার ডা. হাফিজুর রহমান জানান, এটি ভাইরাস রোগ। তারা রোগের কারণ নির্ণয়ে নমুনা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছেন। আক্রান্ত সব প্রাণির চিকিৎসা চলছে বলে জেলা প্রাণীসম্পদ অফিসার জানান। 

কেএসটি

আরও পড়ুন