• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০৩:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০৩:৪৯ পিএম

জয়পুরহাটে চিকিৎসক সংকট, সেবা বঞ্চিত কয়েক লাখ মানুষ

জয়পুরহাটে চিকিৎসক সংকট, সেবা বঞ্চিত কয়েক লাখ মানুষ

জয়পুরহাটে ১৫০ শয্যার জেলা আধুনিক হাসপাতাল। ৫০ শয্যার ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং তাদের অধীনে উপ-স্বাস্থ্য/সাব-সেন্টারগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে জোড়া তালি দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য সেবা। আবার কোথাও ৩০ শয্যার জনবলের মধ্যে সংকট নিয়ে আজও চলছে ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে নেই জেলা আধুনিক হাসপাতালসহ ৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও)। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার কয়েক লাখ মানুষ।

জেলা আধুনিক হাসপাতাল, ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও তাদের অধিনে উপ-স্বাস্থ্য/সাব-সেন্টার কেন্দ্রগুলোতে অনুমোদিত ১৪১ পদের বিপরীতে বর্তমানে ৫৬ জন চিকিৎসক গণনায় আছেন। আবার অনেক পদে পদায়ন করা হলেও তারা যোগদান করেননি। পদ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে এ জেলায় ৮৫টি পদে চিকিৎসক নেই। এদের মধ্যে ডা. সাবা আল গালিব ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। কাগজে কলমে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে তিনি জেলার পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকলেও তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংযুক্ত আছেন। 

বর্তমানে জেলার কর্মরত ৫৬ জন চিকিৎসক তাদের নিজ দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আন্তঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ, এ্যানেসথেসিয়া, অর্থোসার্জারি, কার্ডিওলজি এবং প্যাথলজি বিভাগসহ অন্যান্য দফতরের সাথে সমন্বয় করে সবসময় ব্যস্ত সময় পার করছেন বলে কর্মরত চিকিৎসকরা জানান। পাশাপাশি প্রতিদিন জেলাজুড়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা শতশত রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নিযুক্ত ওই ৫৬ জন চিকিৎসক। 

জেলা আধুনিক হাসপাতাল, ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও তাদের অধিনে ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ-স্বাস্থ্য/সাব-সেন্টারগুলো মিলিয়ে যে ৫৬ জন চিকিৎসক নিযুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ চিকিৎসকই কর্মস্থলে অবস্থান করেন না। তারা বিভিন্ন জেলা শহরে অবস্থান করে প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতলগুলোতে টাকার বিনিময়ে রোগী দেখছেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া চিকিৎসক সংকটের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে সবকটি উপ-স্বাস্থ্য/সাব-সেন্টারগুলো প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৫০ শয্যার জেলা আধুনিক হাসপাতাল এবং ৫০ শয্যা বিশিষ্ট জয়পুরহাট সদর, কালাই, আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল ও পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট দীর্ঘ ৭/৮ বছরের বেশি সময় থেকে আজও আছে। জেলা আধুনিক হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক, সার্জারি, মেডিসিন, গাইনী, অর্থোসার্জারি, কার্ডিওলজিসহ বিশেষজ্ঞ মিলে ৪৩ জনের পদ থাকলেও সেখানে বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৭ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ১৬টি পদ। 

জয়পুরহাট সদর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩ জনের বিপরীতে কর্মরত আছে ২ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ১১টি পদ। পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮ জনের বিপরীতে কর্মরত আছে ৯ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ৯টি পদ। কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬টি পদের মধ্যে কর্মরত আছে ৮ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ১৮টি পদ। ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হলেও আজও সেই জনবল ১৫টি পদের মধ্যে কর্মরত আছে ৬ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ৯টি পদ এবং আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬টি পদের মধ্যে কর্মরত আছে ৪ জন চিকিৎসক। শূন্য আছে ২২টি পদ। 

জেলাজুড়ে ১৪১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৫৬ জন চিকিৎসক থাকলেও যেখানে বেশি সংখ্যক চিকিৎসক আছে সেখান থেকে জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত না করায় অনেক সময় চিকিৎসকের অভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই চিকিৎসা সেবার কাজ করছেন। ফলে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের, আর তখন ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ রোগীরা। 

বিগত ৭/৮ বছর ধরে শূন্য রয়েছে জেলার সবকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ। আবার এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয় কিন্তু আজও ১৪টি পদে পদায়ন করা হয়নি। রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহারিক যন্ত্রপাতির দিক থেকে জেলার আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি মাত্র অকেজো এক্স-রে মেশিন ছাড়া সবকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সকল যন্ত্রপাতি সচল আছে। জনবল সংকটের কারণে এসব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বলতে গেলে জনবল সংকটের কারণেই জেলার সবকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন প্রকার অপারেশনের কাজ হয় না। তাছাড়া রক্তের গ্রুপ, প্রসাব, মলসহ অন্যান্য পরিক্ষা-নিরীক্ষার কাজও বন্ধ আছে। 

সাধারণ রোগীদের অভিযোগ, জেলা সদরসহ সবকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপযুক্ত সেবা না পেয়ে সামান্য সমস্যাতেই চিকিৎসকরা বেশি ঝামেলা মনে করে রোগীদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা অন্যান্য জেলা শহরে স্থানান্তর করেন। ফলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাধারণ রোগীরা বড়-বড় শহরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও পাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্র নির্ভর হয়ে পড়ছেন। এতে করে হত দরিদ্র রোগীদের ভোগান্তির সীমা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর সুযোগ বুঝে ফায়দা লুটতে ভুল করেন না ওই সব ক্লিনিক ও প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসকরা। অনেক সময় আবার রোগীরা হাতুরে চিকিৎসকের খপ্পরেও পড়েন। তাই সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি নিরসনে শূন্য পদে চিকিৎসক সংযুক্ত ও নতুন পদে পদায়নসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন জেলার সাধারণ জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিতে আসা সোনামুখি গ্রামের কৃষক ইকবাল হোসেন আনোয়ার এবং আলেয়া বেগম বলেন, জীবন বাঁচানোর তাগিতে সরকারের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার আশায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তো দূরের কথা জেলা আধুনিক হাসপাতালেও গিয়ে লাভ নেই। পুরো দিনটাই নষ্ট। চিকিৎসাও নিতে হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে। ফলে অর্থ ও সময় দুটোই নষ্ট। রোগীদের এ সব ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে প্রত্যেকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ অত্যন্ত প্রয়োজন। 

পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা পাকুরিয়া গ্রামের জহুরা বেগম ও শালাইপুর গ্রামের নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক কষ্টে টিকিট পাইছি। একজন ডাক্তার রোগী দেখছেন সেই সকাল থেকে। আমরা এখনও সিরিয়াল পাইনি। কখন যে ডাক্তারের সিরিয়াল পাব তা বলা যাচ্ছে না।

পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শহিদ হোসেন জানান, বর্তমানে জরুরি বিভাগ, আন্তঃবিভাগ, বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগসহ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক যথারীতি চালু আছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে অপারেশন থিয়েটার সচল করা যাচ্ছে না। এমনিতেই চিকিৎসক সংকটে আছি, তারপর আবার একজন চিকিৎসক সহকারী সার্জন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় সংযুক্ত আছেন।

সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি আমরা অবগত। এ ব্যাপারে চিকিৎসক সংকটের কথা উল্লেখ করে প্রতি মাসেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু কোন সাড়া মিলেনি আজ পর্যন্ত। তবে মাঝে মধ্যে ২/১ জন নতুন ডাক্তার যোগদানের খবর পাওয়া গেলেও কর্মস্থলে যোগদানের পূর্বেই অজ্ঞাত কারণে তারা বদলির আদেশ নিয়ে ঢাকাসহ বড়বড় শহরের হাসপাতালগুলোতে যোগদান করেন। ফলে মফস্বল এলাকাগুলোতে চিকিৎসক সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। সংকট থেকে পরিত্রাণের সহজ পথ কি হতে পারে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া বদলানো দরকার। ৪/৫ বছর পর পর একবারে ১০ হাজার বা ১৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ নয়, প্রতি বছর দেড়/দুই হাজার করে চিকিৎসক নিয়োগ করলেই এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে  উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমরা আশাবাদি সরকার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

কেএসটি

আরও পড়ুন