• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০১৯, ১০:৩৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০১৯, ১০:৩৩ এএম

মুন্সীগঞ্জ এখন ফেনসিডিল-ইয়াবার হাট 

মুন্সীগঞ্জ এখন ফেনসিডিল-ইয়াবার হাট 

নদীবেষ্টিত জেলা মুন্সীগঞ্জ ফেনসিডিল-ইয়াবার মতো মরণ নেশার হাটে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে  মাদক ব্যবসায়ীরা বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকদ্রব্য কিনে এনে সাধারণ অভাবী শ্রেণীর বখাটে ছেলে-বৃদ্ধ ও কম বয়সী মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। আর এতে মূল গডফাদাররা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই জেলার অধিকাংশ এলাকা এখন ফেনসিডিল, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, ইয়াবার ছোবলে চরমভাবে আক্রান্ত। স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্করাও এই নেশার জালে জড়িয়ে গেছে। নেশার কথিত রঙিন উন্মাদনায় কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন যুবসমাজ। এমন এক অবস্থায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন অভিভাবকসহ সচেতন মানুষ।

সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার শহর-শহরতলীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক মাদকের স্পট ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ শহরের কোটগাঁও, কলেজপট্টি, নতুনগাঁও, নয়াগাঁও, গনকপাড়া, নয়াগাঁও পূর্বপাড়া, বাগমামুদালী পাড়া, উত্তর ইসলামপুর, খালইষ্ট, দক্ষিণ ইসলামপুর, মুন্সীরহাট, সিপাহিপাড়া, হাতিমাড়া, চর-মুক্তারপুরসহ প্রায় এলাকায় বর্তমানে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। প্রশাসনের কঠোর অভিযান না থাকার কারণে মাদক বিক্রেতারা এখন প্রকাশ্য দিবালোকে ফেনসিডিল ও ইয়াবা বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। 
এ সুযোগে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মাদক কারবারিরা। এ জেলায় বাবা আরিফ, শাহজালাল, মকবুলসহ শীর্ষ পর্যায়ের ১০ জনের বেশি মাদক কারবারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও দ্বিতীয় সারির মাদক ব্যবসায়ীরা এখন সরগরম করে তুলেছে ইয়াবা-ফেনসিডিলের ব্যবসা। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তারা এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, মুন্সীগঞ্জের বেশিরভাগ উপার্জনক্ষম পুরুষরা বিদেশে এবং ব্যবসা করে থাকেন। ফলে অভিভাবক না থাকায় ওইসব পরিবারের সন্তানরা বেপরোয়া চলাফেরা করে এসব মরণনেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে একপর্যায়ে তারা মাদকসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মুন্সীগঞ্জে এমন অনেক মাদক স্পটের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে নিয়মিতভাবে প্রকাশ্যেই ইয়াবাসহ নানা মাদক কেনাবেচা হয়। শহরের মানিকপুর, গনকপাড়াসহ নতুনগাঁওয়ে গত কয়েকদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার পরে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় দালানবাড়ি, অটো-রিকশার গ্যারেজ ও বিদেশ লোক পাঠানো দালাল ও মাদক সেবী-বিক্রেতারা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। তাদের আশপাশেই অবস্থান করছিল ১০ থেকে ১২ জন মাদক বিক্রেতা তরুণ। হাতে তাদের ইয়াবা ও ফেনসিডিল। একটু পর পর সেখানে আনাগোনা বাড়ছিল। আবার মোটরসাইকেল বা হেঁটে অনেককে সেখানে যাওয়া-আসা করতে দেখা যায়। কেউ ঝোপের আড়ালে কেউবা প্রকাশ্যেই সেখানে মাদকের পসরা বসিয়েছিল। শহরের গনকপাড়া এখন যেন মাদকের হাট। 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক মাদক বিক্রেতা বলেন, ‘নতুনগাঁও এই শহরের সবচেয়ে বেশি পরিচিত মাদকের স্পট থাকলেও পুলিশি তৎপরতায় অনেকে এখন গাঁ ঢাকা দিয়েছে এবং মাদক বিক্রি ছেড়ে অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ও দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে এ এলাকায় পুলিশের অভিযান তৎপরতায় মাদক বিক্রি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে উল্লেখিত নামের মাদক ব্যবসায়ীরা এই এলাকা ছেড়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায় দিব্বি মাদক বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। এইখানে তবে বর্তমানে ভিন্ন কৌশলে যেমন- সিলেট থেকে পাথরের গাড়ির ভিতরে সু-কৌশলে বড়-বড় চালান মুন্সীগঞ্জে প্রবেশ করিয়ে বাবা (ইয়াবা) ও ফেনু (ফেনসিডিল) কেনাবেচা বেশি হচ্ছে। বাবা কেনাবেচা সহজ ও নিরাপদ হওয়ায় এইডা বেশি চলে। ফেনুর (ফেনসিডিল) দাম বেশি, এক বোতল বিক্রি হয় পনেরো থেকে দুই হাজার টাকায়। 

গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যানুসারে আরো জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে বর্তমানে শীর্ষ পর্যায়ের মাদক কারবারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শহরের মানিকপুরের শহিদ, হোসেন মিজি, শফি, হাসান, রুহুল আমিন, স্বপন, জনি, রনি, আসলাম, সেন্টু, মুক্তার, কালো দুলাল, খালইস্টের ইকবাল, কোটগাওয়ের রুহুল আমিন, উত্তর ইসলামপুরের রাতুল, উত্তর ইসলামপুরের রাসেল, নতুনগাঁও পূর্বপাড়ার জনি, (বর্তমানে জেলে), পঞ্চসারের দূর্গাবাড়ির মাসুম, গনকপাড়াঁর হারুন ও ইকবাল, ফরাজীবাড়ি ঘাটের রহমান, উত্তর ইসলামপুরের রাসেল, পঞ্চসার এলাকার মো. রাসেল, পাঁচঘড়িয়াকান্দির আল-আমিন (সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার), সিপাহিপাড়ার মো. লিংকনসহ আরও অনেকেই মরণ নেশা ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ নানা মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। 

মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মাদকমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সমাজ গঠনে। এ লক্ষ্যে নিয়মিত মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করা হচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে আসছে মাদকবিরোধী প্রচারণায়, আমরা সে সুযোগ করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবার সচেতন হতে হবে।

এদিকে, মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মুন্সীরহাট, গুহেতকান্দি, চরাঞ্চলের চরডুমুরিয়া, মোল্লাকান্দি, বাংলাবাজার, শিলইসহ শহর-শহরতলির প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জের দুরত্ব এক ঘণ্টার। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে বোরখা পরিহিত অবস্থায় ছোট ছোট মেয়ে ও নারীদের দিয়ে অর্ডার করে নিয়ে আসা হয় স্থল ও নৌপথে এ মাদক। 

অভিযোগ রয়েছে শহরের উপকণ্ঠ চর-মুক্তারপুরের নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে স্থানীয় মাদক বিক্রেতার সিন্ডিকেট নৌপথে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা থেকে মুন্সীগঞ্জে আনা হচ্ছে। 
এ প্রসঙ্গে শহরের উপকণ্ঠ চর-মুক্তারপুর এর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জানান, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা-বানোয়াট-উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

মুন্সীগঞ্জ-১ (মুন্সীগঞ্জ সদর-গজারিয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস বলেন, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে কাজ করে চলেছেন। উন্নয়নের মাধ্যমে বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের রূপ। সেই উন্নত করার জন্য বড় প্রয়োজন নতুন প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম যদি মাদকের ছোবলে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে দেশের তাহলে এ দেশ পিছিয়ে পড়বে। মাদক থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এলাকার জনপ্রতিনিধি বা নেতারা যদি এগিয়ে আসে তাহলে কোনোভাবেই মাদক বিস্তার লাভ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আসুন মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখি, সুন্দর সমাজ গড়ি।

মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, মাদকের তৎপরতা এখনো রয়েছে। এ কারণে মাদকবিরোধী অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনকি মাদকমুক্ত মুন্সীগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বাহিনী বা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে জেলায় টাস্কফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মুন্সীগঞ্জ নদীবেষ্টিত জেলা হওয়ায় নৌরুট দিয়ে মাদকের চালান আসছে বলে খবর শোনা যায়। এ কারণে ইতোমধ্যেই কোস্ট টহলরত পুলিশ ও কোস্টগার্ডকেও সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে মাদক প্রতিরোধ হবে। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। এতে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না।

মুন্সীগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুন্সীগঞ্জে বর্তমানে মাদকই প্রধান সমস্যা হিসেবে রয়েছে। এটি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তবে বিগত দুই থেকে তিন বছরে বেশ কিছু শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর মাদক তৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে। তবে সেটি থেমে নেই। তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জে প্রচলিত মাদকের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই ইয়াবা। এরপর ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকের প্রচলনতো রয়েছেই। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।

এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম মাদকের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে। এরই মধ্যে পুলিশের কঠোর অভিযানের ফলে মুন্সীগঞ্জে মাদক ব্যবসা অনেকাংশে কমে আসছে। নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়ে মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। মাদকের প্রশ্নে কাউকেই কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। মাদক-অস্ত্র বিক্রেতাদের কোন প্রকার ছাড় দেবার প্রশ্নই আসে না। এতে যদি কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কেএসটি

আরও পড়ুন