• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০১৯, ০৮:৫৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২, ২০১৯, ০৮:৫৮ এএম

মহাদেবপুরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

মহাদেবপুরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

নওগাঁর মহাদেবপুরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বাল্যবিয়ে। আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে বাল্যবিয়ে হলেও বন্ধ করতে পারছে না প্রশাসন। দিন যতই যাচ্ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ও প্রশাসনের নানা উদ্যোগ বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক প্রচার প্রচারণাসহ কোনো প্রক্রিয়াই ঠেকাতে পারছে না উপজেলার অধিকাংশ এলাকার বাল্যবিয়ে। অনেকেই এর কারণ হিসেবে প্রশাসনের নজরদারীকে দায়ী করছেন। এ নিয়ে সচেতন মহলে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে অনেক অভিভাবক বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন মেয়েদের। অথচ, বাস্তবতা বুঝে ওঠার আগেই একে তো সংসারের দায়িত্ব, অন্যদিকে অকালে মা হচ্ছে এসব কম বয়সী মেয়ে। এতে নতুন করে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তাদের। যে বয়সে হাতে বই থাকার কথা, সে বয়সে কোলজুড়ে সন্তান। কাঁধে স্কুল ব্যাগের বদলে সংসারের বোঝা। স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বহু কিশোরীকে। চোখের বড় স্বপ্নকে আড়াল করে তাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে ঘর-সংসারে। 

এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বাল্যবিয়ের কঠোর শাস্তি না দেয়ার বিষয়টিকে দোষারোপ করছেন সচেতন মহল। এছাড়া বেশি বেশি করে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডই পারে বাল্যবিয়ে রোধ করতে এমনটাই ধারণা স্থানীয়দের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরে উপজেলার আখতার সিদ্দিকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ১১ জন, ৯ম শ্রেণির ৫ জন, ৮ম শ্রেণির ১ জন ও ৭ম শ্রেণির ৫ জন মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্যবিয়ে বেশি সংগঠিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পারছে না প্রশাসন কিংবা সামাজিক সংস্থাগুলো। এ ক্ষেত্রে বর-কনে পক্ষ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। কোনো কোনো বাল্যবিয়ে গোপন স্থানে এবং বাড়ির বাইরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আবার কোনো কোনো অভিভাবক ভুয়া জন্ম সনদও ব্যবহার করছে। যার ফলে এ নিয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। 

বাল্যবিয়ের খবর পেয়ে কখনো প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও অনেক বাবা মা দু-একদিন পর বর-কনেকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। উপজেলার বাল্যবিয়ে খ্যাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের উত্তরগ্রাম, শিবরামপুর, উত্তরগ্রাম হাটখোলা, বামনসাতা, ভালাইন ও সফাপুর ইউনিয়নের বাশবাড়িয়াসহ এর আশপাশের গ্রামগুলো।

উপজেলার সচেতন মহল মনে করছেন, শুধু বাল্যবিয়ের সময়ই নয় বিয়ের পরও যদি বর-কনে পক্ষকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে বাল্যবিয়ে অনেকটাই কমে যাবে। উপজেলার যে সব কাজীরা অর্থের লোভে বাল্যবিয়ে সম্পাদন করে আসছে তাদেরকেও সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এই বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শারীরিক বিকাশের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করায় এক ধরনের মানসিক চাপে পড়ে যায়। যার ফলে পারিবারিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এসব কন্যা শিশুরা বিষণ্মতা ও সমন্বয়হীনতায় ভুগতে থাকে। যা পরবর্তীতে ব্যক্তিত্ব সমস্যা সৃষ্টি করে। তারা তখন পরিবার ও সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হয়। আর তখনই তারা রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যায়। তাছাড়া অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন তারা। পূর্ণ মানসিক বিকাশের আগে মা হওয়ার কারণে সন্তানের দিকে সঠিক মনোযোগ তারা দিতে পারেন না। ফলে অল্প বয়সী মায়ের সন্তানরা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না।

গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমান খোকন বলেন, যতই দিন যাচ্ছে উপজেলাতে বাল্যবিয়ে দেওয়ার ঘটনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও সদস্যদের উদাসীনতায় এই ঘটনাগুলো বেশি বৃদ্ধি হচ্ছে। কারণ বিয়ে রেজিস্ট্রি করার সময় বয়স প্রমাণের জন্য অবশ্যই ইউনিয়ন পরিষদের সদনপত্র প্রয়োজন হয়। তারা কিভাবে একটি মেয়ের বিয়ের বয়স না হলেও জন্মসনদ প্রদান করে। বাল্যবিয়ে রোধ করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। শুধু অর্থদণ্ডই নয়, বেশি বেশি করে সশ্রম কারাদণ্ড দিতে হবে, যেন আশপাশের মানুষও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার মানুষদের বাল্য বিয়ে সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

আখতার সিদ্দিকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, প্রশাসনের অনিহার কারণে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ রাখি না বা রাখতেও পারব না। আমরা বাল্যবিয়ে ঠেকাতে চাই, কিন্তু তা গোপনে সংগঠিত হয়। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং জনসচেতনতামূলক কর্যক্রম চলছে। সমাজের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। প্রশাসন বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

কেএসটি

আরও পড়ুন