• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০১৯, ০২:৩০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১১, ২০১৯, ০২:৩০ পিএম

খুলনায় বুলবুলে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

খুলনায় বুলবুলে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

দেশের উপকূলীয় এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে খুলনা অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ধসে পড়ে বসবাসের অযোগ্য হয়েছে কয়েক হাজার। কৃষি, মৎস্য খাতে ব্যাপক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ লাইন, মিটার, ফিডারসহ নানান যন্ত্রপাতি। গ্রাম্য রাস্তাঘাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। ঝড়ের কবলে পড়ে খুলনায় মারা গেছেন ২ জন। এখন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। শনিবার (৯ নভেম্বর) মধ্যরাতে খুলনা উপকূলে আঘাত হনে ঘূর্ণিঝড় ’বুলবুল’।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে ভেঙে পড়া গাছগাছড়া সরিয়ে নিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে কাজ করছেন  সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। এরইমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন অধিকাংশ মানুষ। 
কিন্তু তাণ্ডবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তাৎক্ষণিক দুর্ভোগে রয়েছেন তারা। অনেকে বাড়ি ফিরে গেলেও বসবাস করা নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন নিজেরা এখন ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের, পুকুর সংস্কারের চেষ্টা করছেন। শুধুমাত্র গ্রামে নয় বুলবুলের আঘাত খুলনা শহরেও পড়লেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। 

ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে মারা গেছেন দুইজন। তারা হলেন- দাকোপ উপজেলার দক্ষিণ দাকোপ গ্রামের সুভাষ মণ্ডলের স্ত্রী প্রমিলা মণ্ডল (৫২) ও খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার  সেনহাটি গ্রামের আলমগীর হোসেন (৩৫)।

পাউবোর বেড়িবাঁধের ক্ষতি 
উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো রয়েছে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে এসব বাঁধ ভেঙে বির্স্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বুলবুলের বিপদ কাটলেও নতুন আতঙ্কে এ জেলার উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। সে আতঙ্কে বর্তমানে অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, বিপদ কেটে গেছে। যেসকল স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো দ্রুত মেরামত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

কয়রা উপজেলার ১৩-১৪/২ পোল্ডারের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া জানান এই পোল্ডারের দশহালিয়া নামক স্থানে বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে গেলে সেটি আটকানো সম্ভব হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধের কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। ১৪/১ ও ১৩-১৪/২ পোল্ডারের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিপদমুক্ত। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডে খুলনা পওর বিভাগ -১ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন এ ডিভিশনে ৩৬৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে যার মধ্যে ১৪টি স্পটে ১ কিলো ৩০০ মিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডে খুলনা পওর বিভাগ-২ নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, এ ডিভিশনে ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও নদী রক্ষা ও তীর রক্ষা বাঁধের ৪ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

কৃষিতে ক্ষতি
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় জেলা খুলনায় ব্যাপকভাবে আমনের আবাদ হয়। এবারও আবাদ হয়েছিল প্রায় ৯১ হাজার হেক্টর (১ হেক্টর= ২.৪৭ একর) জমিতে। যার মধ্যে সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেরায় আমনের আবাদ হয় ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে। এছাড়া সবজির আবাদ হয় প্রচুর জমিতে। বুলবুলের আঘোতে আমন ক্ষেতসহ সবজিতে ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এর মধ্যে আমন ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫ হাজার হেক্টর জমি। শীতকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৬৪ হেক্টর, পেঁপে ক্ষেত নষ্ট হয়েছে ১০০ হেক্টর, কলা ক্ষেত নষ্ট হয়েছে ৫২ হেক্টর, পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৬ হেক্টর, সরিষা ক্ষেত নষ্ট হয়েছে ৪০ হেক্টর। সব মিলিয়ে কৃষিতে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকার মত। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার এ তথ্য জানিয়েছেন।

মাছ ও চিংড়িতে ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে মাছ ও চিংড়িতে ৭৮ কোটি ২৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে মাছের ক্ষতি হয়েছে ৪৭৭ মেট্রিক টন, চিংড়িতে ক্ষতি ১ হাজার ২৯০ দশমিক শূন্য ৭ মেট্রিক টন। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর ও দিঘীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৭৫টি, ঘেরের সংখ্যা ২ হাজার ৭৭২টি। পুকুরের আয়তন ৫৩৭ দশমিক ৫০ হেক্টর ও ঘেরের আয়তন ১ হাজার ৩৫১ হেক্টর। এছাড়া পোনার ক্ষতি হয়েছে ২০ লাখটির। খুলনা মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহানাজ পারভীন এ তথ্য জানিয়েছেন। 

বিদ্যুতের ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে কুলনা পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবির আওতায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরইমধ্যে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে যাওয়া, তার ছিড়ে যাওযা, মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ ফিডারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুত্যের খুঁটি ভেঙেছে ২০০টির মত। ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার বৈদ্যুতিক মিটার, ৮০০ স্থানে ছিড়েছে তার। খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার। রোববার (১০ নভেম্বর) পর্যন্ত ৩০ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেয়া হয়েছে। সোমবারের (১১ নভেম্বর) মধ্যে ৮০ ভাগ গ্রাহককে বিদ্যুতের সংযোগ চালু করতে পারবেন বলে জানালেন খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. আলতাফ হোসেন। তিনি জানান, গ্রাহকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিজস্ব জনবলসহ কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলা থেকেও জনবল আনা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। 

স্থাপনা ও ঘরবাড়ি
খুলনা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বুলবুলের আঘাতে ৪৭ হাজার ২৭৫টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরইমধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৪৫৫টি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭ হাজার ৮২০টি ঘরবাড়ির। নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ মানুষ। এছাড়া কয়েক লাখ ছোট-বড় গাছ ভেঙে পড়েছে। গ্রামীণ সড়ক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধেরও ক্ষতি হয়েছে। 

খুলনা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (ডিআরআরও) মো. আজিজুল হক জোয়াদ্দার জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে যাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় সেজন্য জেলা প্রশাসনসহ সকল দপ্তর ব্যাপক সতর্ক ছিল। ঝড়ের পূর্বে জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রায় ২ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। যারা সকলেই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। 
সবকিছু মিলিয়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডব শেষে এখন চলছে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। 

কেএসটি

আরও পড়ুন