• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০১৯, ১১:৫৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৭, ২০১৯, ০৩:৪৯ পিএম

৭ ডিসেম্বর আনন্দ-উল্লাসে মেতেছিল গোপালগঞ্জবাসী

৭ ডিসেম্বর আনন্দ-উল্লাসে মেতেছিল গোপালগঞ্জবাসী

আজ ৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত হয়। সেদিন দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠেছিল আনন্দ উল্লাসে। যা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে গোপালগঞ্জবাসীর কাছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হবে দিবসটি। 

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ ও রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে এমন প্রত্যাশা গোপালগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আর সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ও গোপালগঞ্জে বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলো চিহ্নিত করে তার স্মৃতি রক্ষার্থে সরকার কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবে এমনটাই দারি করেছেন তারা।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে গোপালগঞ্জে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম গোপালগঞ্জে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের লড়াই। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহকুমা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদের সহযোগিতায় ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ (তৎকালীন কায়েদে আযম মেমোরিয়াল কলেজ) মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু হয়। ২৫ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গোপালগঞ্জ মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল।
৩০ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী শহরে ঢুকতে শুরু করে। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও-ধর্ষণ আর হত্যাযজ্ঞ। কর্নেল তারেক ও মেজর ঘুরির নেতৃত্বে পাকসেনারা স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে গোপালগঞ্জ শহরের ব্যাংকপাড়াস্থ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থান জেনে নিয়েই জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। ৬০ এর দশকে ব্যাংকপাড়াস্থ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দু’টি ছিল এ অঞ্চলের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এরপর পাকসেনারা ৫-৭টি দলে বিভক্ত হয়ে শহরের স্বর্ণপট্টি, চৌরঙ্গী রোড, সাহাপাড়া ও বাজার এলাকায় চালায় লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ।

মুহুর্তে শ্মশানে পরিণত হয় এলাকাগুলো। জ্বালিয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ অফিস ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ঘর-বাড়ি। মানিকহার গ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয় কায়েদে আযম মেমোরিয়াল কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দাসসহ শত-শত নিরীহ মানুষকে। সন্তোষ কুমার দাসই হলেন এ অঞ্চলের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। এছাড়া সদর উপজেলার কাঠি ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামের হাফিজুর রহমান বাদশা মিয়ার পরিবারের বড় ছেলেসহ একই পরিবারে ৮ জনকে গুলি করে হত্যা এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী।
পরে পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ সদর থানা পরিষদ সংলগ্ন ‘জয় বাংলা পুকুর’ পাড়ে একটি মিনি-ক্যান্টনমেন্ট (বর্তমানে উপজেলা পরিষদ ও ওহাব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন) স্থাপন করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ নারী-পুরুষ ধরে এনে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে এটি পরিণত হয় একটি বধ্যভূমিতে।

জয়ের নেশায় সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী তাড়া করে পাক বাহিনীকে। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও পরাজিত করতে হবে পাকহানাদার বাহিনীকে। শত্রু মুক্ত করতে হবে প্রিয় জন্মভূমিকে। ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তলগ্নে মিত্র দেশ ভারত প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার স্বীকৃতি প্রদান করায় এখানকার পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।
পরের দিন সূর্য উঠার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। রাতে চারিদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বলয় রচিত হওয়ার খবর পেয়ে পাক সেনারা গোপালগঞ্জ সদর থানা উপজেলা পরিষদ (বর্তমানে) সংলগ্ন জয় বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেজর সেলিমের অধিনে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল চলে যায় রাজধানী ঢাকায়। আর অন্য একটি দল চলে যায় ভাটিয়াপাড়ার ওয়ারলেস ক্যাম্পে।

অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে গোপালগঞ্জের আকাশে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা। শহীদদের রক্ত আর বীর মুক্তিযোদ্ধারে সাহসী যুদ্ধে অবশেষে শক্রমুক্ত হয় গোপালগঞ্জ। সে দিনটির কথা মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গোপালগঞ্জবাসী আজও আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাই দিনটি পরম পাওয়ার একটি দিন। শত দুঃখ-কষ্ট ও আত্মত্যাগের পর বিজয়ের আনন্দ ঘন এক মুহূর্ত। মুক্তিসেনারা শহরের দিকে আসছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী জনতার মনে সেদিন আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাই জনতার বিজয় উল্লাস সেদিন সূর্যদয়ের মত আজও বিস্তৃত করে দিক দিগন্ত। শহরবাসী মেতে উঠেছিল অসীম আনন্দ উৎসবে।

গোপালগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি লড়াই হয়। ৩০ এপ্রিল থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ মাস ৭ দিন গোপালগঞ্জ ছিল পাকহানাদার বাহিনীর দখলে। গোপালগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইগুলো সংঘটিত হয় সদর উপজেলার পাইককান্দি, ঘোড়াদাইড় ও কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরায়।
এই সব যুদ্ধে সাধুরহাটির জয়নাল, মিন্টু, রাজাপুরের ইব্রাহীম, রামদিয়ার শ্রী কৃষ্ণ কলেজের ছাত্র ইয়াসির, ফুকরার রবিউল, বাহিরবাগের ইমাম উদ্দিনসহ বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দাস, গোবরার গোলজার হোসেন চৌধুরী, সিহাব উদ্দিন মোল্লা, আব্দুল লতিফ ফকির, ছাত্রনেতা মাহবুব, প্রবীণ শিক্ষাবিদ গোবিন্দ ঠাকুর।

এছাড়া নিহত হন ইউসূফ আলী সিকদার, গোপাল অধিকারী, আব্দুল হাই শেখ ও শচীন্দ্রনাথ বৈদ্যসহ অসংখ্য মুক্তিকামী সাধারন মানুষ। এসকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজও অম্লান হয়ে আছে। আজও এসব বীর সেনানির নাম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছে। 

এরই মাঝে বিভিন্ন সময়ে ক্যাপ্টেন মিলু, ক্যাপ্টেন শিহাব, ক্যাপ্টেন মফিজ, ক্যাপ্টেন হালিম, ইসমাত কাদির গামা, শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু (বর্তমানে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান), চৌধুরী এমদাদুল হক (বর্তমানে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি), হেমায়েত উদ্দীন বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন সোবহান, কমান্ডার মনি রায়, হেকমত সিকদার, ক্যাপ্টেন জালাল আহম্মেদ, কমান্ডার মতিয়ার, রসিক লাল, ক্যাপ্টেন ইকবাল, কমলেশ বেদজ্ঞ, সৈয়দ নওশের আলী প্রমুখের নেতৃত্বে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াই পরিচালিত হয়।

কেএসটি