• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ০৯:০৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১০:৩৩ এএম

শাশুড়িসহ তিনজনকে হত্যা করে পুত্রবধূর পরকীয়া প্রেমিক 

শাশুড়িসহ তিনজনকে হত্যা করে পুত্রবধূর পরকীয়া প্রেমিক 

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর এলাকায় প্রবাসীর মা ও ভগ্নিপতিসহ তিনজনকে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। প্রবাসীর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশু ও রাজমিস্ত্রি জাকিরের অবৈধ সম্পর্ক দেখে ফেলায় শায়েস্তা করতে গিয়েই ঘটে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা। আর এর মূল পরিকল্পনায় ছিল প্রবাসীর স্ত্রী মিশু। যা বাস্তবায়ন করে তার পরকীয়া প্রেমিক জাকির।

আদালতে ঘাতক জাকির হোসেন ও তার সহযোগী জুয়েলের দেয়া জবানবন্দি এবং পুলিশের তদন্তে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর এই তথ্য বেরিয়ে আসে। যদিও ঘটনার মাস্টারমাইন্ড প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রব এর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশুর মুখ থেকে এখনো কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ।

এ কারণে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) তাকে ট্রিপল মার্ডার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এসময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মিশুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদাল।

বানারীপাড়া থানা পুলিশ এবং আদালত সূত্রে জানাগেছে, ‘১১ বছর ধরে কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রব। সেখানকার একটি মসজিদে ইমামতি করেন তিনি। সর্বশেষ গত ১১ মাস পূর্বে বাড়িতে এসেছিলেন আব্দুর রব। দাম্পত্ত্য জীবনে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শাশুড়ি মরিয়ম বেগমের সঙ্গে শিশু সন্তানদের নিয়ে থাকতো মিশরাম জাহান মিশু।

দেড় বছর পূর্বে কুয়েত প্রবাসী আব্দুর রবের বাড়ির নির্মাণের সময় রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতো ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বাসিন্দা জাকির হোসেন। তখন থেকেই আব্দুর রব হাওলাদারের পরিবারের সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে জাকিরের। একপর্যায় প্রবাসীর স্ত্রী মিশুর সাথে রাজমিস্ত্রি জাকিরের পরকীয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। যা পরবর্তীতে শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। পাশাপাশি জাকির হোসেন রাজমিস্ত্রি হলেও সে জ্বিন-পরীর কথা বলে ঝাড়-ফুঁক দিয়ে নানান রোগের সমাধান করার কথা বলে প্রবাসীর পরিবারের নারী সদস্যদের মন জয় করে।

পুলিশ আরও জানায়, ‘কয়েক মাস পূর্বে মিশরাত জাহান মিশুর লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। যা ভালো করে দেয়ার জন্য তাকে সালসা ও তাবিজ কবজের তদবির দেয়ার নামে ছয় হাজার টাকার চুক্তি করে। এসময় মিশুর দেবরের মেয়ে কলেজ ছাত্রী আছিয়ার বাচ্চা হয়ে হবে না বলে ভয় দেখিয়ে তাকেও চিকিৎসার কথা বলে আড়াই হাজার টাকা দাবি করে।

কিন্তু আছিয়া গবিব হওয়ায় সে ওই টাকা দিতে পারবে না বলে জানালে জাকির কৌশলে জিন-পরীর দোহাই দিয়ে তাকে ফ্রিতে তদবির দেয়ার আশ্বাস দেয়। তাছাড়া খুন হওয়া প্রবাসীর খালাতো ভাই ইউসুফের হারিয়ে যাওয়া একটি মোবাইল ফোন জিনের সাথে কথা বলে পায়িয়ে দেয়ার আশ্বাসও দেয় কথিত ওঝা জাকির। এভাবেই জিন-পরীর ভয় দেখিয়ে মিশুর সঙ্গে সক্ষতা গড়ে তোলে জাকির।

এদিকে, কিছুদিন আগে মিশরাত জাহান মিশুকে ভণ্ড ওঝা জাকির হোসেন জড়িয়ে ধরে। যা দেখে ফেলে মিশুর খালাতো দেবর ইউসুফ। যা নিয়ে পরিবারের লোকেদের সঙ্গে আলাপ করে ইউসুফ। তাছাড়া তাদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি টের পেয়ে যায় মিশুর শাশুড়ি মরিয়ম বেগম। তাই বিষয়টি নিয়ে ভিতু হয়ে পড়ে জাকির ও মিশু। এ কারণে মিশু ইউসুফকে সরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি শাশুড়িকে শায়েস্তা করার জন্য বলে জাকিরকে।

সেই সূত্র ধরে গত শুক্রবার হত্যাকাণ্ডের রাতে ইউসুফকে তার প্রবাসীর বাড়িতে থাকতে বলে মিশু। এমনকি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বাড়ির প্রধান দরজা কৌশলে খোলা রেখেই ঘুমাতে যাওয়ার নাটক করে সে। পাশাপাশি জাকিরকে সাথে আরো একজন লোক সাথে নিয়ে বাড়িতে আসার জন্য বলে মিশু।

তার কথা মতো জাকির বরিশাল সদর উপজেলার কাগাশুরা এলাকার বাসিন্দা অটোরিক্সা চালক জুয়েলকে সাথে নিয়ে মিশুর বাড়িতে আসে। জুয়েলকে বাড়ির পাশে টিউবওয়েলের কাছে বসিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে ঢোকে জাকির। পরে মাফলার ও বালিশ দিয়ে শ্বাসরোধ করে প্রথমে ইউসুফ ও পরে মরিয়ম বেগমকে হত্যা করে। এসময় ঘুমের ঘোরে কাশি দেয় শফিকুল আলম।

পুলিশ সূত্র জানায়, ‘প্রবাসীর ভগ্নিপতি শিক্ষক শফিকুল আলমকে হত্যার কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু জাকির ভেবেছিল দু’জনকে হত্যার বিষয়টি প্রবাসীর ভগ্নিপতি টের পেয়ে গেছে। এ কারণে তাকেও একইভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। সকলের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে সহযোগী জুয়েলকে ঘরে ঢাকে জাকির। পরে তার সহযোগিতায় ইউসুফের মৃতদেহ বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে ও মরিয়মের মৃতদেহ বারান্দায় নিয়ে রাখা হয়।

পুলিশ জানায়, ‘হত্যাকাণ্ডের পরে মিশরাত জাহান মিশুকে তার কক্ষ থেকে ডেকে আনে জাকির হোসেন। এছাড়া মরিয়ম বেগমের পাশে শুয়ে থাকা নাতনি কলেজ ছাত্রী আছিয়া আক্তারকে ডেকে মিশুর রুমে দুই সন্তানের কাছে পাঠানো হয়। এসময় জাকির ও জুয়েলকে দেখতে পায় আছিয়া।

অপরদিকে, হত্যাকাণ্ডের জন্য মিশুর কাছে টাকা দাবি করে জাকির। এজন্য ঘটনার পরে রাত ৪টা ২১ মিনিটে মিশু তার নিজ নম্বর থেকে জুয়েলের মোবাইলের বিকাশ নম্বরে ৫ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা পরবর্তীতে জাকিরকে দেয়ার কথা বলে। এ কারণে ওই রাতেই ঘটনা যাতে কারোর কাছে প্রকাশ না করে সে জন্য শাশুড়ির মোবাইল দিয়ে মিশুর সঙ্গে আপত্তিকর কিছু ছবি তুলে রাখে জাকির।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও আছিয়াকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে জাকির। এ কারণে তাকে ধর্মীয় দুর্বলতার ভয় দেখিয়ে সার্বিক বিষয়ে কাউকে যাতে কিছু না বলে সে জন্য আছিয়াকে পবিত্র কোরআন শরীফে হাত রেখে শপথ করিয়ে কেটে পড়ে জাকির হোসেন ও জুয়েল।

তবে হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে র‌্যাব-পুলিশের ঘটনাস্থলে যাবার বিষয়টি কোন এক নারীর মাধ্যমে জানতে পারে জাকির। আর তাই নিজেকে ঘটনা থেকে আড়াল করতে কৌশলগত কারনে জাকির শনিবার সকালে পুনরায় ওই বাড়ির আশে পাশে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই পুলিশ তাকে আটক করে।

বরিশাল জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আব্দুর রকিব জানিয়েছেন, ‘হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মাফলারটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে নগরীর সাগরদী এলাকায় জাকিরের ভাড়া বাসা থেকে র‌্যাবের সহায়তায় প্রবাসীর বাড়ি থেকে খোয়া যাওয়া কিছু স্বণালংকার ও ছুরি উদ্ধার করে। এর পাশাপাশি বরিশাল কাউনিয়া থানাধীন কাগাশুরা এলাকা থেকে জাকিরের সহযোগী জুয়েলকে আটক করে র‌্যাব। তাছাড়া জাকিরের স্বীকারক্তি অনুযায়ী রোববার রাতে গ্রেফতার করা হয় প্রবাসীর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশুকে।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘জাকির প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। কিন্তু এ বিষয়টি কোনভাবেই স্বীকার করছে না মিশু। এজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। তাছাড়া জুয়েলকে কাজের কথা বলে বানারীপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি ঘাতক জাকিরের।

প্রসঙ্গত, শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে প্রবাসী আব্দুর রব এর বাড়ি থেকে তার মা মরিয়ম বেগম (৭০), ভগ্নিপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শফিকুল আলম (৬০) ও খালাতো ভাই ইউসুফের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

কেএসটি
 

আরও পড়ুন