• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১০:০০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১০:০০ এএম

উপেক্ষিত বেগম রোকেয়া-২

মুখ থুবড়েই পড়ে আছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি   

মুখ থুবড়েই পড়ে আছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি   

অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দ এখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত। আন্তরিকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ’ হিসেবে গড়ে তোলা ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’টি। 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আজ। ইতোমধ্যেই কেন্দ্রের অবকোঠামো আসবাবপত্র অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামসহ মূল্যবান মালামাল অযত্ন অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে। পোকা খেয়ে শেষ করছে লাইব্রেরির মূল্যবান বইপত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রায় এক যুগ ধরে বিনা বেতনেই আগলে রেখেছেন এর যাবতীয় অবকাঠামো। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও যেন নেই কোন মাথা ব্যথা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাংলা সাহিত্যে দেশের গৌরবদীপ্ত এবং সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থা বাংলা একাডেমি, সেই একাডেমির প্রকাশিত কোন বই-ই এখন এই পাঠাগারে নেই। এমনকি এই কেন্দ্রে নেই রোকেয়ার কোন রচনাবলী, এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে লেখা কোন বইও।

সমাজ পরিবর্তনে পুরুষের রক্তচক্ষু শাসিত শত বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে যে মহীয়সী রংপুরের এই অজপাড়াগাঁ-পায়রাবন্দ থেকে জ্বালিয়েছিলেন নারী শিক্ষার আলো, যে পায়রাবন্দ থেকে সমাজের যত অনাচার কুসংস্কার দূর করে জগতখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। তার সে স্বপ্ন-স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে যেখানে গড়ে উঠেছিল এ কেন্দ্রটি। স্থানীয়রা অবিলম্বে এ স্মৃতি কেন্দ্রকে রাহুমুক্ত করে এর কার্যক্রম চালুর দাবি তুলেছে।

রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে পায়রাবন্দে তার নামে একটি মহিলা ক্যাডেট কলেজ স্থাপনসহ নানা দাবি ছিল এ অঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের। ’৯৬ সালে তৎকালীন সরকার রোকেয়ার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার আদর্শে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই ‘রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। স্মৃতি কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয় সেমিনার কক্ষ, ২৫০ আসনের মিলনায়তন, আর্কাইভ, গবেষণা কেন্দ্র, নামাজ ঘর, রোকেয়া ও তার উত্তরসূরীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর, সংগ্রহশালা, দেশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য অতিথিশালা, কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার, ভাষ্কর্য এবং আকর্ষণীয় একটি তোরণ। এখান থেকে রোকেয়ার উপর ফেলোশিপ প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল। 
২০০১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন এবং কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এ কেন্দ্রটিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে। সে থেকেই এর কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। একে একে তুলে নেওয়া হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লোকবল। 

কেন্দ্রটিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা প্রসঙ্গে তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহা-পরিচালক ড. সাহেদ জানিয়েছিলেন, যেহেতু বিষয়টি নারী সংশ্লিষ্ট এটি একটি কারণ, অন্যটি হলো- অর্থাভাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক কাজ করতে পারে না বলেই মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটিকে ন্যস্ত করা হয়েছে। 

তবে এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার তথ্য সংগ্রাহক ও স্মৃতি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নেওয়া হবে? তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে রাজবাড়িতে ‘মীর মোশাররফ স্মৃতি কেন্দ্র’ নামে আরও একটি প্রকল্প রযেছে, সেটিকে তো অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে নেয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 

দুলাল আরও বলেন, একজন লেখক কিংবা মনীষীর কোন জেন্ডার নেই। নারী পুরুষের ভেদাভেদ ও বৈষম্য ভুলে সমাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে রোকেয়া সমাজ থেকে দূর করেছেন অনাচার আর কুসংস্কার তিনি নিজেই আজ সেই বৈষম্যের শিকার। আক্ষেপ করে তিনি আরও জানান, নারী বলে এবং নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন বলেই যদি এই স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়, তবেতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মোশাররফ, লালন সাঁই এদের জন্যও পুরুষ বিষয়ক মন্ত্রণালয় খোলা দরকার।
 
রোকেয়ার উত্তরসূরী বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রঞ্জিনা সাবের চৌধুরী জানান, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্মৃতি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা তার কী বাস্তবায়ন হবে না? 

কেন স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হচ্ছে না এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিষয়। তিনি জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই কেন্দ্রকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার প্রক্রিয়া নেওয়া হলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনিসহ ২ কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন। তাতে তারা স্মৃতি কেন্দ্রটিকে যেন অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর না করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন জানান। পরে এই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৫ সালে বাদীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর ও কেন্দ্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নেয়া এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পক্ষে রায় দেন। পরবর্তীতে সরকার পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে। পরে আপিল বিভাগও সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে স্মৃতি কেন্দ্রটিকে আবারও বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবাধানে সংস্কৃতি বিয়য়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির কাছে পুনরায় ন্যস্ত করার পরও বাংলা একাডেমি আজও কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। 

কেএসটি

আরও পড়ুন