• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১২:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১২:৩৯ পিএম

শিশুদের মৃত্যুকূপ চট্টগ্রাম ম্যাক্স হাসপাতাল

শিশুদের মৃত্যুকূপ চট্টগ্রাম ম্যাক্স হাসপাতাল

গত দু‘বছরে একের পর এক শিশুর মৃত্যুর ঘটেছে চট্টগ্রাম ম্যাক্স হাসপাতালে। এর মধ্যে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত কারণে তিন শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। তুমুল আন্দোলনও হয়েছে সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যু নিয়ে। হয়েছে মামলা।  

প্রশ্ন উঠেছে এটা কি হাসপাতাল, না কি শিশুদের মৃত্যুকূপ। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এত অভিযোগ-আন্দোলনের পরেও আইনগত কোন আঁচড় লাগেনি নগরীর মেহেদিবাগে অবস্থিত বেসরকারি এই ম্যাক্স হাসপাতালের গায়ে। 
অভিযোগের তদন্তে এই হাসপাতাল পরিচালনায় কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার প্রমাণও মিলেছে। যা চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। এরপরও দিব্যি চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। 

সাজা বলতে যা হয়েছে, রাইফার মৃত্যুর পর আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৮ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নানা অনিয়মের কারণে ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়, এতটুকুই। 

জানা যায়, ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান, গাইনি চিকিৎসক আফরোজা ফেরদৌস, সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড আল্ট্রাসাউন্ডে কর্মরত এইচ এম রাকিবুল হকসহ অধিকাংশই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক। যারা সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনা করছেন। এদের সাথে রয়েছেন চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপ ও ড্যাবের অনেক নেতা। যাদের প্রভাবে কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। 

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর রোববার বিকালে ম্যাক্স হাসপাতালের পরিচালকসহ ৩ চিকিৎসককে আসামি করে দণ্ডবিধির ৩০৪(ক)/১০৯ ধারায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত কারণে গর্ভাবস্থায় শিশু মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়ের করেন ইউসুফ আলম মাসুদ নামে এক আইনজীবী। 

মামলাটি আমলে নিয়ে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান, মামলার বাদীর আইনজীবী আবদুস সাত্তার।  

মামলার বিবরণ থেকে তিনি বলেন, গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আইনজীবী ইউসুফ আলম মাসুদের স্ত্রীর পূর্ব নির্ধারিত ডেলিভারির ডেট ছিল। ডা. আফরোজা ফেরদৌসের অধীনে তার নিয়মিত চেকআপ চলছিল। ১ ডিসেম্বর পেটে ব্যথা অনুভব করায় তাকে ওই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডা. আফরোজা ফেরদৌস রিপোর্ট দেখে বলেন, সব ঠিক আছে, নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি হবে। এরমধ্যে ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথাও কমে যায়। ৩ ডিসেম্বর দুইটার দিকে আবার তীব্র ব্যথা শুরু হলে তাকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার জানান, বাচ্চা গর্ভাবস্থায় মারা গেছে।

একইভাবে চলতি বছরের ২১ নভেম্বর ম্যাক্স হাসপাতালে মারা যায় ১৩ মাস বয়সের শিশু জিহান সারোয়ার প্রিয়। তার মায়ের অভিযোগ, একটি ইনজেকশন পুশ করার আধঘণ্টা পর সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ নিয়ে ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন মা মোহছেনা আক্তার ঝর্ণা।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৭ নভেম্বর তার সন্তান জিহান সারোয়ার প্রিয় অসুস্থ বোধ করলে তাকে ম্যাক্স হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ২১ নভেম্বর দুপুরে আমার সন্তানকে মেশিনের মাধ্যমে ধীরে ওষুধ দেওয়ার কথা থাকলেও অনভিজ্ঞ নার্স ওই ওষুধের শেষের অংশ হাত দিয়ে পুশ করেন। আর তখনই আমার সন্তান পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়।

এর আগে গত বছরের ২৮ জুলাই শিশু রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় বাবা সাংবাদিক রুবেল খান নগরীর চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি আসামি করেন ম্যাক্স হাসপাতালে দায়িত্বরত শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান রায় চৌধুরী, দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও শুভ্র দেব এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলীকে।
মামলার এজাহারে রুবেল খান অভিযোগ করেন, চার চিকিৎসকের অবহেলা ও গাফিলতিতে রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় না হওয়া এবং ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও অতিরিক্ত মাত্রায় সেডিল প্রয়োগের কারণে তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। রাইফার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তারা সুষ্ঠু তদন্ত করেনি বলেও অভিযোগ করেন সাংবাদিক রুবেল খান।

অবশ্য এর আগে রাইফার অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছিল সিভিল সার্জন গঠিত তদন্ত কমিটি। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। তদন্তে ম্যাক্স হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম ও ত্রুটি নিয়ে ১১টি সুপারিশ তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

১৫০ শয্যার এ হাসপাতালে লাইসেন্স নবায়নে ত্রুটি, হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগপত্র না থাকা, প্যাথলজি বিভাগ ও চিকিৎসকের কোনো তথ্য নেই বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। কিন্তু এতো অভিযোগ থাকার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত হাসপাতালটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম সির্ভিল সার্জন অফিসে অভিযোগ করেও বিচার পাচ্ছি না। সিভিল সার্জনে অভিযোগ করলে কমিটি হয়, তদন্ত হয়, কিন্তু কোনো শাস্তি হয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও ম্যাক্সের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাই হাসপাতালটিতে থামছে না মৃত্যুর মিছিল।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. শেখ মু. ফজলে রাব্বি বলেন, একাধিক অভিযোগ আছে ম্যাক্সের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ভিত্তিতে আমার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত শিগগিরই শুরু হবে। তদন্তে ডাক্তারের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি বা অবহেলা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোনো ভুল চিকিৎসা বা অবহেলা হয়নি। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কোনো ক্রটি পাইনি। সব অভিযোগের তদন্ত হলে ত্রুটিমুক্ত হবে ম্যাক্স হাসপাতাল।

কেএসটি

আরও পড়ুন