• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ১০:০০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ১০:০০ এএম

‘মরণের পর রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকু যেন দেয়া হয়’

‘মরণের পর রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকু যেন দেয়া হয়’

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই করে যুদ্ধ করেছি। একাত্তরে আমি ছিলাম এক টগবগে তরুণ, পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য এবং নিজের বিবেকের তাড়নায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। তখন কারো সনদ বা সার্টিফিকেট নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। দীর্ঘ সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের হারিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে স্বাধীন স্বদেশে কোন সনদ নেয়ার উৎসাহ ও প্রয়োজন বোধ করিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সুযোগ-সুবিধা বা কোন ভাতা পাইনি এবং চাইনি। সমগ্র জীবনটা কর্মের সংগ্রাম আর দেশ গঠনে কাজ করেছি। এখন আমার বয়স ৭৩ বছর। আমি এখন জীবন সায়াহ্নে। সদাশয় সরকারের কাছে আমার জীবনের শেষ চাওয়াটি হলো- আমাকে যেখানে সমাহিত করা হবে, সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকু যেন দেয়া হয়।

জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে কথাগুলো বলেছেন- ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মমিন চৌধুরী। 

ছাত্র রাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতি, সাংবাদিকতার পাশাপাশি, ’৬৯র গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১র স্বাধীনতা সংগ্রামে এক লড়াকু সৈনিক ছিলেন আবদুল মমিন চৌধুরী।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মমিন চৌধুরী ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মাওলানা আবু আহমেদ, একজন ইসলামী চিন্তাবিদ এবং  বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ’কোরান চর্চায় সহায়’ গ্রন্থের রচয়িতা। মাতা মরহুমা হুরের নেছা চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে আমি টগবগে তরুণ। বয়স ২৬ বছর। মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হলে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর মুন্সীর হাটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছি এবং রাতে বিলোনীয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের শ্রীনগর ক্যাম্পে যোগ দেই। এই ক্যাম্পে ফাজিলপুরের মর্তুজা ভূঁঞা, অ্যাড. গিয়াস উদ্দিন নান্নুসহ অনেকে ছিলেন। সেখানে ইনচার্জ ছিলেন ব্যারিস্টার নুরুল আফসার। 

সেখানে ট্রেনিং শেষে জুন মাসের দিকে অধ্যাপক বাদল দত্তসহ আমাদের কয়েকজনকে কিছু গ্রেনেড দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। তখন আমরা ঢালুয়া সীমান্ত দিয়ে সেনবাগ হয়ে ছমিরমুন্সী কুতবেরহাট হয়ে বসুরহাট আসি। সেখান থেকে ফেনী নদীর উপর স্লুইসগেট পার হয়ে কাজীরহাট হয়ে মঙ্গলকান্দি দিয়ে নিজ এলাকায় প্রবেশ করি। উদ্দেশ্য মা-বাবার সাথে শেষবারের মত দেখা করা এবং স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করা।

বাংলাদেশে কিছুদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আগস্ট মাসের দিকে আমরা পাঁচগাছিয়া, রাজাপুর, সিন্দুরপুর, আলকরা মাঠ হয়ে গিনাগাজী দিয়ে ভারতের চোত্তাখোলা পৌঁছি। সেখানে তখনকার সময়ে টঙ্গীর শ্রমিকনেতা ইব্রাহীম রাতেরবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত দিয়ে পারাপারে সহযোগিতা করতেন। ভারতের চোত্তাখোলায় আমরা পুনরায় ট্রেনিং নিয়ে আবার বাংলাদেশে রওয়ানা হই। তখন আমাদের সাথে ছিলেন আত্রাই কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল বাবু বাদল দত্ত, মঙ্গলকান্দি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শশাঙ্ক দাস গুপ্তসহ (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) আরো কয়েকজন। সেসময় কে-ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

দেশে ফিরে আবদুল মমিন চৌধুরী সহযোগী মুক্তিযোদ্ধদের সাথে মরণপণ লড়াই করে পাক হানাদার বাহিনী ও আল বদর, আল সামসসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতায় গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মমিন চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেন, জীবদ্দশায় দেশে এবং নিজ জেলায় কখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন প্রকার সম্মান পাইনি বলে কোন দুঃখ নেই্। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মরণের পর যেন রাষ্ট্রীয় সম্মনটুকু দেয়া হয়। এইটুকু জীবনের শেষ চাওয়া।

এই ব্যাপারে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফেনী শাখার সাবেক সভাপতি আবদুল মোতালেব বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু বার বার আহবান সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ে নাম নিবন্ধন বা সংশ্লিষ্ট ফরম পূরণ করে জমা দেননি। তাদের বিষয়ে সীদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সরকারের বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। 

ফেনী জেলা প্রসাশক মো. ওয়াহিদুজজামান বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে সরকারের নীতিমালার আলোকে সবকিছু করা হচ্ছে।

কেএসটি

আরও পড়ুন