• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২০, ০৮:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৪, ২০২০, ০৮:৫৯ পিএম

শিল্প-কারখানার বর্জ্যে প্রাণ হারিয়ে ফেলছে সুতাং নদী

শিল্প-কারখানার বর্জ্যে প্রাণ হারিয়ে ফেলছে সুতাং নদী
শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে সুতাং নদীর কালো কুচকুচে পানি - ছবি : জাগরণ

শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে হবিগঞ্জের সুতাং নদী যেন প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। নদীতে স্বচ্ছ পানির কোনো অস্তিত্ব নেই, আছে শুধু শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কালো কুচকুচে পানি। একসময়ের খরস্রোতা নদীটি এখন মৃতপ্রায়। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করা ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য এ নদীটিকে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত করেছে। এতে অস্তিত্ব হারাচ্ছে এ নদীটি।

শিল্পবর্জ্যের দূষণে নদীটি এখন এলাকাবাসীর দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নদীটি একসময় মানুষের নিঃস্বার্থ উপকার করে যেত, সেই নদীই এখন মৃত্যুফাঁদ। এর প্রধান কারণ কোম্পানিগুলোতে নিয়মিত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ব্যবহার না করা। ফলে মারাত্মক দূষণে পানি বিষাক্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় কয়েক হাজার জেলে। অন্যদিকে চাষাবাদে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। এছাড়া নদীর পানি ব্যবহার করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে। আর যাদের এসব দেখভাল করার কথা, সেই পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন যেন কিছুই দেখছে না। মনে হয় কোম্পানিগুলোর এসব অনিয়ম দেখার যেন কেউ নেই।

জানা যায়, সুতাং নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লাখাই উপজেলার মাদনা এলাকা হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনার শাখা কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিদের নজরদারির অভাবে বহমান এ নদীটি কালের আবর্তে বিলীন হতে চলেছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণের ফলে ভারত থেকে আসা উজানের পানি ও পলি মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে নদীটি।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অলিপুর শিল্প এলাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয়রা জানান, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানার দূষিত বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। এখানে গড়ে ওঠা অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নেই প্রয়োজনীয় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি)। যেসব কোম্পানিতে ইটিপি রয়েছে, সেগুলো অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না। সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেখাতে অনেক কোম্পানি ইটিপি স্থাপন করেছে। কিন্তু এগুলো বন্ধ রেখে কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে। অথচ শিল্প-কারখানায় ইটিপি ব্যবহার  বাধ্যতামূলক। রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। ফলে নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার নুরপুর, রাজিউড়া, ফান্দ্রাইল, সানাবই, উচাইল, বেকিটেকা, নাজিরপুর, লুকড়া,  লাখাই উপজেলার করাব, বুল্লা, বেগুনাই, বরগান্দিসহ বেশ কটি ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উদ্বেগজনক মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে সুতাং নদীর পানি কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সুতাং নদীর পানি দূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকায় রয়েছে প্রাণ (আরএফএল) ও স্কয়ার কোম্পানির একাধিক প্রতিষ্ঠান। তারা অলিপুর এলাকায় বিশাল আয়তন নিয়ে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিষাক্ত বর্জ্যের মারাত্মক দূষণে পানি বিষাক্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় কয়েক হাজার জেলে। অন্যদিকে চাষাবাদে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এছাড়া হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এর বেশির ভাগই সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে। নদীর পানির অভাবে প্রতিবছর চাষাবাদ করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়। এতে ব্যাহত হচ্ছে বোরো উৎপাদন।

লাখাই উপজেলার ফুলতৈল গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভাটি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় বন্যার সময় সব জমিতে পানি উঠে যায়। আগে বন্যার পানি উঠলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। কিন্তু এখন আর জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় না, উল্টো জমি নষ্ট হয়ে যায়। কারণ সুতাং নদীর পানি বিভিন্ন কোম্পানির ময়লা-আবর্জনায় নষ্ট হয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নদীর পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জমিতে আগে যে পরিমাণ ধান হতো, এখন আর সে পরিমাণ ধান হয় না। আমরা সাধারণ মানুষ কয়েক বছর ধরে খুব অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছি।’

সদর উপজেলার উচাইল গ্রামের কৃষক হারিছ মিয়া বলেন, ‘আমরা আগে সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে বোরো ধান চাষ করতাম। কিন্তু নদীর পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে গভীর নলকূপ দিয়ে চাষ করতে হচ্ছে, যাতে খরচ দ্বিগুণের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ধান চাষ করে আর লাভবান হওয়া যাচ্ছে না। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে ধান চাষ করা বাদ দিয়ে দিচ্ছেন।’

এছাড়া নদীর পানি ব্যবহার করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ করে কোনো সুফল পাননি।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম বাবুল বলেন, ৪-৫ বছর আগে জাইকার সহযোগিতায় কৃষিকাজে সেচের জন্য শৈলজুড়া নামক খালটি পুনঃখনন করা হয়। ওই খাল দিয়ে প্রাণ, স্কয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানি এলাকাবাসীর বাধার মুখেও তাদের বর্জ্য ছাড়ছে। এসব বর্জ্য শৈলজুড়া খাল দিয়ে সুতাং নদীতে ঢুকছে। এর ফলে খালসহ নদীর পানি দূষিত ও দুর্গন্ধময় হয়ে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনও রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে নির্বিকার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, গবাদিপশু ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বাপা স্থানীয়দের নিয়ে বেশ কয়েকবার আন্দোলন করেছে। পরিবেশদূষণের অভিযোগে মাধবপুর উপজেলার শাহপুরে অবস্থিত মার লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে বন্ধ করে দিয়েছিল এলাকাবাসী। কিন্তু আবার গোপনে চালু হয়েছে কোম্পানটি। পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগসাজশে চলছে এসব অনিয়ম। তিনি বলেন, সুতাং নদী এখন স্থানীয়দের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সরকার যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে স্থানীয়দের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

এনআই

আরও পড়ুন