• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২০, ১১:৩০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৭, ২০২০, ১২:৩৯ এএম

বিবিচিনি কলেজ

অধ্যক্ষ-সভাপতির যোগসাজশে নিয়োগ দুর্নীতি, বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান

অধ্যক্ষ-সভাপতির যোগসাজশে নিয়োগ দুর্নীতি, বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার বিশ্বাস ও ম্যানেজিং কমিটি সভাপতি আবদুল খালেক (ডানে)

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

......

বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি নিয়ামতি যুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে চলছে দুর্নীতির অভিনব প্রক্রিয়া। অভিযোগ রয়েছে, দৃশ্যত সব নিয়মের আড়ালে চলছে দুর্নীতি আর অনিয়মের খেলা। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট তা উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে। যার আরও একটি উদাহরণ সামনে এলো বরগুনার এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। যেখানে সুপারিশকৃত প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করোতে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকের মত ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকেও।

সম্প্রতি এমনই অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সরেজমিন অনুসন্ধানে নামে দৈনিক জাগরণ। যার এক পর্যায়ে আলাপকালে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার বিশ্বাস দৈনিক জাগরণ প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, সবই চলছে নিয়ম অনুসারে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুসন্ধানে নিয়মের সেই আবরণ খানিকটা তুলে ধরতেই দেখা যায় অনিয়মের বীভৎসতা। কলেজে নির্বাচিত সদস্য থাকলেও সব সিদ্ধান্ত নেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবদুল খালেক ও অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার বিশ্বাস।

সম্প্রতি সন্তানের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে জাগরণের সঙ্গে কথা বলেন, জেলার বেতাগী উপজেলাধীন ১ নং বিবিচিনি ইউনিয়নের নিয়ামতি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ, যিনি পেশায় একজন সংবাদপত্র বিক্রেতা। ৫ সন্তানের জনক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের দ্বিতীয় সন্তানের নাম আল ইমাম। ২০১৮ সালে বিবিচিনি নিয়ামতি যুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে ৩.৬১ জিপিএ পেয়ে পাস করে।২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় একই কলেজে আইসিটি ল্যাব সহকারী পদে ১ জন এবং পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে ১ জনের নিয়োগ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যার প্রেক্ষিতে পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে আবেদন করেন আল ইমাম।

পরে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রিন্সিপাল প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের সই করা পত্রে ইমামকে ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২ ঘটিকায় বরগুনা সরকারি কলেজে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। আইসিটি ল্যাব সহকারী পদে ৪ জন এবং পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে ৬ জন মোট ১০ জন আবেদনকারী আবেদন করেন। 

আবেদনের কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ জানতে পারেন, বিবিচিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভায় সভাপতি আবদুল খালেক ও প্রিন্সিপাল প্রদীপ কুমার বিশ্বাস কমিটির অন্যান্য সদস্যদের অবগত করেছেন, ওই পদে যারাই চূড়ান্ত হবেন, তাদের স্কুল উন্নয়ন ফান্ডে ৫ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। তবে হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ কোনও টাকা দিতে পারবেন না বলে কমিটির সদস্যদের জানিয়ে দেন।

এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি আল ইমামসহ আরও ৩-৪ জন আবেদনকারী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বরগুনা যায়। তারা কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারেন পরীক্ষার তারিখ পেছানো হয়েছে। একই দিন বিকালে উক্ত লিখিত পরীক্ষা পেছানোর প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমারের সই একটি পত্র ইমামের ঠিকানায় আসে। যেখানে পরবর্তী লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ৪ মার্চ ২০২০ বলে উল্লেখ করা হয়। পত্রটিতে সই করা হয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে। 

তবে পরীক্ষার সেই পরিবর্তিত তারিখের আগেই প্রার্থীরা ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের মারফত জানতে পারেন, উক্ত দুটি পদে এরই মধ্যে দুইজন প্রার্থীর নিয়োগ প্রাপ্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। যেখানে আইসিটি ল্যাব সহকারী পদে বেতাগী উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল সিকদার এবং পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী পদে কর্তব্যরত সিত্রা রানীর পুত্র বিনয় হাওলাদার কলেজ সভাপতি ও অধ্যক্ষের সুপারিশে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য মনোনীত হন।

আল ইমামসহ আরও কয়েকজন আবেদকারী জানান, এ তথ্য জানতে পেরে বাকিরা ৪ মার্চ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাননি। ফলে সেই পরীক্ষা বাতিল হয়। পরবর্তীতে সভাপতি এবং অধ্যক্ষের দ্বৈত সিদ্ধান্তে গোপনে ১০ মার্চ পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। তবে এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্যরা কিছুই জানতেন না বলে মন্তব্য করেন। 

প্রতিষ্ঠানের একটি সূত্রের তথ্য মতে, পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে তারই আরও ৫ জন আত্বীয়-স্বজন আবেদন করেন। গত ৩ জুলাই ২০২০ তারিখে তাদের নিয়োগ পরীক্ষা হয়। ১০ জুলাই ম্যানেজিং কমিটির সভার রেজুলেশন বইয়ে দেখা যায় বিনয় হাওলাদার পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন। তবে বিতর্কিত ইস্যু হওয়ায় এই রেজুলেশনে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচিত ৪ সদস্য, শিক্ষক প্রতিনিধিসহ মোট ৭ জন  সই করা থেকে  বিরত থাকেন। পরে কলেজের দফতরি হরিদাসের মাধ্যমে রেজুলেশন বই সদস্যদের দ্বারে দ্বারে পাঠিয়ে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। যেখানে কমিটির ৪ জন অভিভাবক সদস্য ব্যাতীত অন্যান্যদের  সই নেয়া হয়।

পরবর্তীতে গত ১২ জুলাই জাগরণ প্রতিনিধি প্রথম দফা অনুসন্ধানে কলেজে গিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপকালে ২৪ ফেব্রুয়ারি পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হবার কারণ জানতে চাইলে, তিনি বলেন ১ জন ছাড়া ওই বিষয়ে পরীক্ষা দিতে কোন পরীক্ষার্থী আসেনি বিধায় আইসিটি ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়ে রুবেল সিকদার চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য মনোনীত হন। পরে জাগরণ প্রতিনিধির সংগ্রহে থাকা তার সই সম্বলিত নিয়োগ পরীক্ষা পেছানোর সেই পত্র দেখালে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন এবং অসংলগ্ন তথ্য দিতে থাকেন। যার এক পর্যায়ে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কখনও বরগুনা জেলা শিক্ষা ডিজি আবার কখনও ম্যানেজিং কমিটির ওপর দায় চাপান। 

২০০৯ সালে প্রদীপ কুমার বিশ্বাস বিবিচিনি নিয়ামতি যুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে যোগদান করেন। এর আগে তিনি বেতাগী সরকারি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। পরে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অভিভাবকদের দাবির মুখে এক পর্যায়ে তাকে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়েছিল। এছাড়া সরকারি কলেজের এক ম্যানেজিং কমিটি সদস্যের করা মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে কমিটির সভাপতি বরাবর ক্ষমাপ্রার্থনা করে পাঠানো পত্রের প্রেক্ষিতে তাকে পুনঃবহাল করা হয়। সে সময় এলাকাবাসী তার অপসারণের দাবিতে হ্যান্ডবিলও ছাপিয়েছিল।

উপজেলার স্থানীয় ব্যবসায়ী রিকু সিকদার বলেন, এই সভাপতি ও অধ্যক্ষ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থাকার কারণে আমরা সাধারণ জনগণ কোনও প্রকার সুবিচার পাইনা। আর আওয়ামী লীগের বড় বড় পদে যারা বর্তমানে আছেন তাদের অধিকাংশই শুধু ক্ষমতা অপব্যবহারের লক্ষ্যে দল করেন। স্থানীয় মানুষ এদের দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য হতে মুক্তি চায়।

এই নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কলেজ ম্যানেজিং কমিটির একাধিক সদস্য অভিযোগ করে জাগরণ প্রতিনিধিকে জানান, তারা পুনঃনিয়োগ সংক্রান্ত কোনও মিটিংয়ের চিঠি পাননি এবং মৌখিকভাবেও তাদের কোনও কিছু অবগত করা হয়নি। পরবর্তীতে বর্তমান সংসদ সদস্যের কথা বলে তাদের ডেকে নিয়ে প্রথম (রুবেল সিকদারের) নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশনে সই করানো হয়। 

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ তার সন্তানের নিয়োগের ব্যাপারে যে অভিযোগ তুলেছেন, সে বিষয়ে স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সাহেবের সন্তানের নিয়োগ ঠেকাতে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও অধ্যক্ষ যেই ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এলাকার ৮০ ভাগ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও অধ্যক্ষ স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ এই সিন্ডিকেটের হাত হতে মুক্তি চায়। এক সময়ের বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলার সবচাইতে নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এই দুর্নীতিবাজদের জন্য আজ তলানীতে এসে ঠেকেছে। প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে তাদের অপসারণের বিকল্প নেই।

কলেজের সভাপতি আবদুল খালেক দৈনিক জাগরণকে বলেন- নিয়োগ পরীক্ষা যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদে পরীক্ষা দিতে কোনও পরীক্ষার্থী আসেনি। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তবে একদিন আগেই কেন প্রিন্সিপাল পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদের পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন হবার পত্র দিলেন?  এই প্রশ্নের জবাবে যথাযথ কোনও উত্তর না দিয়ে জাগরণ প্রতিবেদকের প্রতি অসৌজন্যতামূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে কি আছে না আছে আমি জানিনা। পরীক্ষার্থী আসেনি তাই পরীক্ষা হয়নি।’

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শহিদুল ইসলাম জানান- ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষায় আইসিটি ল্যাব সহকারী পদের সব পরীক্ষার্থী এসেছিল কিন্তু  পদার্থ বিজ্ঞান ল্যাব সহকারী পদের কোনও পরীক্ষার্থী আসেননি। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে কিভাবে একদিন আগেই প্রিন্সিপাল পরীক্ষা পেছানোর পত্র আবেদনকারীদের ঠিকানায় পাঠালো? তার অর্থ তিনি আগে থেকেই জানতেন কেউ আসবেন না? তবে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সে ব্যাপারে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

বেতাগী উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিব আহসান জাগরণ প্রতিনিধিকে বলেন, এই ব্যাপারে আমি কোনও অভিযোগ পাইনি, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

এসকে/কেএপি