• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২০, ১০:২৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৩, ২০২০, ১০:২৮ এএম

সুদখোরেরা বেপরোয়া : আইন না থাকায় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুলিশ

সুদখোরেরা বেপরোয়া : আইন না থাকায় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

বগুড়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সুদখোররা। বিনা লোকসানে এই ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গ্রামগঞ্জের কিছু অসাধু প্রকৃতির মানুষ। কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নিজের খেয়াল খুশি মতো উচ্চ মাত্রার লাভে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধু তাই নয় সুদ গ্রহিতার কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ও ফাঁকা চেক নিয়ে জিম্মি করছে তাদের। অনেক ক্ষেত্রে আসল ও কিছু সুদের টাকা পরিশোধ করলেও সুদের সুদ দিতে না পারলে ঐ দুই কাগজের বলে আইনের মারপ্যাচে জেলে যেতে হচ্ছে অসহায় সুদ গ্রহিতাকে।

জেলার শিবগঞ্জ, সোনাতলা,সারিয়াকান্দি,গাবতলী,দুপচাচিয়াসহ প্রায় সব উপজেলার পাড়ায় পাড়ায় চলছে সুদের ভয়াবহ আগ্রাসন। শিবগঞ্জের গুজিয়া, টেপাগারী,আলিয়ারহাট, দাড়িদহ, ভায়েরপুকুর, মোকামতলা,ভরিয়া,মালাহার,মুরাদপুর, রহবল, গাংনগর, বিহার, বড়িয়াহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় দিন দিন সুদের ব্যবসা বেড়েই চলেছে। দৈনিক, সপ্তাহিক ও মাসিক হারে চলছে জমজমাট এ ব্যবসা।
 
ইতোপূর্বে উপজেলার অনেকেই সুদ মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। সুদের টাকাকে কেন্দ্র করে খুন, অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। সুদখোরের লাথিতে অন্ত:সত্বা মায়ের গর্ভপাতের ঘটনা ও সুদ গ্রহিতা ব্যক্তির জানাযা নামাজ আটকিয়ে সুদের দেন দরবার করার মতো অমানবিক কাজও ঘটেছে। 

সুদ গ্রহিতাদের বিভিন্নমুখী নির্যাতন ও সুদখোরদের এমন দৌড়াত্ব বন্ধে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ প্রশাসন। তাদের দাবি সংবিধানে সুদখোরদের দৌরাত্ব বন্ধে নেই কোন আইন। তাই এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে পারেন না তারা।

সুদের ভয়াল ছোবলে নি:শ্ব হওয়া উপজেলার লস্করপুর গ্রামের মিজান মিয়া জানান, আমি বিপদে পরে এক সুদখোরের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছিলাম। তারা আমার ব্যাংক চেক জমা ও সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। সেই টাকার ৫ গুন লাভ দিয়েও  ঋণের হাত থেকে রেহাই পাইনি। পরে সুদ শোধ করতে সমিতি থেকে কিস্তি তুলি। এভাবে দেনা বাড়তে বাড়তে বাড়ির যায়গা পর্যন্ত বিক্রি করে এখন আমি নিঃস্ব। 

আমজানি গ্রামের ফজলার,কিচক মাঠিয়ান গ্রামের ইফসুফ, মোকামতলা চানপুর গ্রামের  শিপন, টেপাগারী গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদসহ অনেকেই জানান, সুদের টাকা দিতে দেরি হলে বিভিন্ন রকম হুমকি ধামকি ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালিও করে সুদখোররা। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করা যায় না। সুদারুদের কাছে সর্বস্ব দিয়েও এর হাত থেকে রেহায় পাননি এসব মানুষ।

উপজেলার রহবল এলাকার পল্লী চিকিৎসক শ্রী মাধব চন্দ্র মেয়ের বিয়ের সময় দেউলী এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসে ২৫ হাজার টাকা সুদ দেয়ার শর্তে দুই লাখ টাকা নেয়। এজন্য দাদন ব্যবসায়ীকে দুইটি ব্যাংক চেক ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে হয়। 

লোনের এ টাকা শোধ করতে গত ২৪ মাসে প্রায় চার লাখ টাকা পরিশোধ করার পরও বাকি সুদ ও আসল মিলে আরো চার লাখ টাকা দাবি করে মাধবকে হুমকি ও মারধর করা হয়েছিল। 

এ টাকা শোধ করতে গিয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের (সুদারু) কাছে সুদে টাকা নিতে হয়েছে মাধবকে। চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ দিতে দিতে ভিটে-মাটি বিক্রি করে তিনি এখন পথের ফকির। পালিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছিলেন তিনি। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে রক্ষা পায় মাধব।

শিবগঞ্জ উপজেলায় মাধবের মতো এমন অনেকেই আছেন, যারা দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারপরও দাদনের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি।

উপজেলার গাংনগর দাখিল মাদ্রাসার সুপার আ. ওয়াহাব দৈনিক জাগরণকে জানান, আমার প্রতিষ্ঠানের দুই জন শিক্ষক-কর্মচারী মোকামতলা এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। পুরো বইয়ের চেক স্বাক্ষর করে দাদন ব্যবসায়ীকে দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা। গত চার বছর ধরে বেতন তুলতে পারছিল না তারা। পরে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির হস্তক্ষেপে তারা রক্ষা পায়।
 
এ ধরনের ভুক্তভোগীরা জানান, ঋণ নেওয়ার আগে দাদন ব্যবসায়ীর কাছে স্বাক্ষর করা চেক বা স্ট্যাম্প জমা রাখতে হয়। তারা চাকরি করলেও মাস শেষে ব্যাংক থেকে বেতনের টাকা তোলেন দাদন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দাদন ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সহজে টাকা তুলে নিতে পারে।

তবে এ নিয়ে দাদন ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দাদন ব্যবসায়ী জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক থেকে সিসি লোন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। তার দাবি, ব্যাংক থেকেও তাদের সুদের হার কম। 

এ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম বদিউজ্জামান দৈনিক জাগরণকে জানান, এসব সুদখোরদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। তবে যদি তারা কোন ফৌজদারি অপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জাগরণ/কেএইচ/এমআর