• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০২:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০২:১৯ পিএম

গোলের রসে জীবন চলে ৩০ পরিবারের

গোলের রসে জীবন চলে ৩০ পরিবারের

নোনা জলে জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ডগা (ডাণ্ডি) থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু গুড় (মিঠা)। যার চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। অভিজ্ঞরা মুখে নিলেই বুঝতে পারেন এ গুড়ের স্বাদের ভিন্নতা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ পরিবার কয়েক বছর ধরে তৈরি করছে এই গুড়। এখানে গোলপাতার চাষও করা হয়।

কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কটি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বরাবর চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতের দিকে। সড়কটি ধরে দক্ষিণে চলতেই রাস্তার ধারে একাধিক স্থানে চোখে পড়ে গোলপাতা গাছের বহর (বাগান)। এমন একটি বহর থেকে রস সংগ্রহ করছেন নীলগঞ্জের ঘুটাবাছা গ্রামের আব্দুর রহিম হাওলাদার। সকাল-বিকেল দুই বেলা চলে তার গোলপাতা গাছের ডগা কাটার কাজ।

রহিম হওলাদার জানান, “এ বছর ঘুটাবাছা খালের পাড়ে জন্ম নেওয়া এক একর জমির গোল বাগান বর্গা নিয়েছি। আমি ও আমার স্ত্রী আমেনা বেগম দুজনে মিলে দিনরাত পরিশ্রম করে বাগানের ৭০টি গোলের ডাণ্ডা থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন কলস রস সংগ্রহ করি। তারপর সেই রস দিয়ে তৈরি করছি প্রায় পাঁচ কেজি গুড়। কলাপাড়া বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে এ গুড় বিক্রি করা হয়। এ দিয়েই চেলে আমাদের সংসার।”

তবে এ বছর গুড় বিক্রি করে প্রায় এক লাখ টাকা আয় করার আশা করছেন আব্দুর রহিম।

নবীপুর গ্রামের গোলবহরে গেলে বহর মালিক নিখিল চন্দ্র হাওলাদার জানান, আষাঢ় মাসে গোলগাছের ডাণ্ডিতে গাবনা ফল হয়। পৌষ মাসে ফলসহ মাটিচাপা দিয়ে ডাণ্ডি নুয়ে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসে ডাণ্ডিটি মানুষের পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রসে ভার করার জন্য দোয়ানো হয়। ১৫ দিন এভাবে দোয়ানোয় পর গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকা ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাণ্ডির কাটা অংশ তিন দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুই বেলা পাতলা করে (এক সুতা পরিমাণ) কেটে ফেলা হয়। এভাবে চলে আরো ১৫ দিন। এরপর প্রতিদিন বিকেলে এক বেলা ডাণ্ডার মাথা দিয়ে কিঞ্চিত অংশ কেটে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন খুব ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবছর পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহ করা। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। এ বছর তারা এক একর জমির বাগানের ১৫০টি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করছেন চার কলসি। প্রতি কলসিতে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। এভাবে প্রতিদিন ১০০ লিটার রস সংগ্রহ করেন। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসিতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি।

আরেক গোলবহরের মালিক বিপুল হাওলাদারের স্ত্রী কল্পনা রানী হাওলাদার বলেন, “লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা) ব্যবহার করা হয়। এই মুথা দিয়ে পুরো বছর ধরে চলে রসসহ সংসারের যাবতীয় রান্নার কাজ।”

গোলবহরের মালিক নিঠুর চন্দ্র বলেন, “গোলবাগান থেকে যে লাভ হয় তা সরল জমিতে ধান চাষ করে হয় না। এক একর জমিতে ধান পেতাম সর্বোচ্চ ২৫ মণ। ৭০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতিবছর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু ওই জমিতে সৃষ্টি হওয়া গোলগাছের বাগান দিয়ে প্রতিবছর আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। তবে সরকারি উদ্যোগে আন্ধারমানিক নদের তীরে জেগে ওঠা চরে গোলগাছ রোপণ করার সুযোগ করে দেওয়া হলে প্রচুর অর্থ আয় হতো বন বিভাগের।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, “বাংলায় পরিচিত গোলপাতার ইংরেজি নাম Nypa palm এবং বৈজ্ঞানিক নাম fruticans, family-palmae। গোলগাছের গুড় ও রসে নানা গুণ আছে। সরকারি উদ্যোগে নোনা অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদীর তীর ও খালের চরে গোলগাছের বাগান তৈরি করা হলে প্রচুর রাজস্ব আয় হতো।”

উপজেলা বন কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, “কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের খাদায় কিংবা খালের তীরে গোলবহর রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে বন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে সুন্দরবন থেকে গোলবহরের বীজ (গাবনা) সংগ্রহ করে রোপণ করে বাগান তৈরি করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয়রাও নিজ উদ্যোগে কৃষিজমির অভ্যন্তরের খালের তীরে গাবনা রোপণ করে বাগান তৈরি করেন। কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় গোলগাছের গুড়ের চাহিদা রয়েছে অনেক। এটি এ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে পরিণত হয়েছে।”

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “আমি গোলপাতার গুড় খেয়েছি। এটা বেশ সুস্বাদু। ইতোমধ্যে গোল চাষিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া গোলের চাষ কীভাবে আরো বৃদ্ধি করা যায় এমন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”