• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২১, ১০:৪৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২, ২০২১, ১০:৪৫ এএম

মাতৃভাষা বঞ্চিত গারো শিশুরা

মাতৃভাষা বঞ্চিত গারো শিশুরা

দশ বছরের শিশু মেঘা চিসিম স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পারিবারিক সূত্রে মা–বাবার কাছে টুকটাক মান্দি ভাষায় কথা বলা শিখলেও হাতে–কলমে গারোদের মাতৃভাষার শিখতে পারেনি। ঘরে বেশির ভাগ সময় মা–বাবা একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন বাংলা ভাষায়। গ্রামের সহপাঠীসহ বাংলাভাষীদের সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশার কারণে একরকম ভুলেই গেছে মাতৃভাষা।

মেঘার মতো এমন অনেক গারো শিশু-কিশোর রয়েছে, যারা মান্দি ভাষার বই কিংবা অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত না। মেঘার পরিবারের মতো অনেক অভিভাবকের এখন আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে এ গ্রাম থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে তাঁদের মাতৃভাষাসহ নিজস্ব সংস্কৃতি।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের দোলমা গ্রামে ৭০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। প্রায় তিন বছর ধরে একটি এনজিওর অর্থায়নে চলা গারোদের মাতৃভাষা শিক্ষার একমাত্র স্কুলটি বন্ধ হয়ে পড়ায় শিশুরা মাতৃভাষার চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, গ্রামের বেশির ভাগ শিশুই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলের ভেতরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্র। এ ব্যাপারে স্থানীয় সচেতন মহলসহ জনপ্রতিনিধিরাও কোনো সহযোগিতা করছেন না।

দুলমা গ্রামের পঞ্চায়েতপ্রধান জগদীশ মারাক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতা অঞ্জনা সাংমা, লিপি সাংমা, সঞ্জলা, মঞ্জলা সাংমা, মুকুলা মারাক অভিযোগ করেন, উপজেলার শেষ প্রান্তে অবস্থান করায় তাঁরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের অনেক জায়গা প্রভাবশালীরা জোর করে নিয়ে গেছে। এখনো উচ্ছেদ–আতঙ্ক তাঁদের পিছু ছাড়ে না। মাতৃভাষা শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার, অথচ গ্রামে মান্দি ভাষা শিক্ষার জন্য একটি মাত্র স্কুল থাকলেও প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এটি। যার ফলে শিশুরা মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য তাদের কাছে কোনো বই নেই, জানে না মান্দি ভাষার অক্ষর কেমন। এই গ্রামের কোনো শিশু এখন আর তার মাতৃভাষায় কথা বলে না। তাঁরা মনে করেন, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি হোক বেসরকারিভাবে হোক, এই স্কুল যাতে আবার চালু করা হয়। মাতৃভাষা থেকে যেন কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশু বঞ্চিত না হয়।

দোলমা গ্রামের শিক্ষার্থী বৈশাখী মারাক, পিংকি দিব্রা, মেঘা চিসিম, আলো হাগিদক, প্রভাতী দাদকসহ ১০ থেকে ১২ জন জানায়, তারা সব সময় বাংলা ভাষায় কথা বলে।

মা–বাবাও বাংলায় কথা বলেন। তবে তাদের মাতৃভাষা মান্দি। মাতৃভাষায় লিখতে–পড়তে পারে না। তারা চায় বাংলা ভাষার পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষা পরিপূর্ণভাবে শিখতে। পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করতে চায়। তাই মান্দি ভাষা শিক্ষার এই স্কুল যাতে দ্রুত চালু হয়, এটাই তাদের চাওয়া।

অন্যদিকে, এনায়েতপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে থাকায় চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। বয়স্ক ভাতার কার্ড, নলকূপ, ১০ টাকা কেজির চালের কার্ডসহ নানা সুবিধা থেকে পিছিয়ে আছে বলে জানান দুলমা গ্রামের মানুষ।

পুরুষদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র ভরসা কুঁচিয়া ধরা হলেও নারীরা বছরের বেশির ভাগ সময় ঘরে বেকার সময় কাটান। উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নে নামীদামী কোম্পানির কারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও অভিযোগ আছে, সেখানে স্থানীয় লোকজনসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন কাজের সুযোগ পান না।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার ফুলবাড়ীয়া শাখার সভাপতি লুইস সুপ্রভাত জেমচাং জানান, ফুলবাড়ীয়ায় গারোদের মাতৃভাষায় শিক্ষায় শিশুরা বেশ পিছিয়ে রয়েছে, অনেক এলাকার স্কুল বন্ধ। আবার করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় আরও ক্ষতি হলো শিশুদের।