• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৫, ২০২১, ১২:২৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৫, ২০২১, ১১:০৫ এএম

সালথায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক

পুরুষশূন্যতায় ফসলি মাঠে নারীরা

পুরুষশূন্যতায় ফসলি মাঠে নারীরা

ফরিদপুরের সালথায় তাণ্ডবের পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় গ্রেপ্তার-আতঙ্কে উপজেলা সদরসহ ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম এখন পুরুষশূন্য।

স্থানীয় লোকজন জানান, গ্রেপ্তারের ভয়ে পুরুষেরা রাতে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। দিনেও হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেলেও রাতে তারা চলে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। এমনকি হাটবাজারের দোকানপাটেও নারী-শিশু ছাড়া পুরুষের দেখা মিলছে না।

সরেজমিন এসব গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, নারী-শিশু ছাড়া গ্রামের বয়স্ক ও বৃদ্ধ পুরুষরা রয়েছেন। এদিকে বেশ কিছু গ্রামে কৃষিপণ্য পাটক্ষেত পরিচর্যার কাজও করছেন শুধু নারীরা।

পাটক্ষেতে কর্মরত এক নারী বলেন, “আমরা পাট-পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল। এটি পাটের মৌসুম। পাটের মধ্যে অনেক ঘাস হয়ে গেছে। এগুলো পরিষ্কার করতে হবে। না-হলে পাট বড় হবে না। এরপর ক্ষেতে পানি, সার, ওষুধ দিতে হবে। আমাদের পুরুষরা বাড়িতে থাকতে পারছে না। পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। বাধ্য হয়ে এই কাজ আমাদের করতে হচ্ছে। তা না হলে তো এই ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কী খেয়ে বাঁচব?”

এই পরিস্থিতিতে পাট-পেঁয়াজের রাজধানীখ্যাত সালথা উপজেলায় এ বছর পাটচাষিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেকেই। পাটশিল্পের জন্য এটি বড় ধরনের অশনিসংকেতও বলছেন সংশ্লিষ্টরা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বলেন, “আমার দুটি ছেলে ঢাকা থাকে। স্বামী অসুস্থ। আমরা সেদিনের ঘটনার কিছুই জানি না। তবু তাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ, শুনেছি যাকে ধরছে সেই আসামি। সেই ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমাদের মসজিদে আজ পাঁচ দিন ধরে কোনো আজান হয় না। মসজিদের দিকে তাকালে চোখের পানি চলে আসে। রোজা চলছে, অথচ ঘরে বাজার নেই। এখন আল্লাহই আমাদের ভরসা।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের কাছে আমার চাওয়া, যারা অপরাধী তাদের বিচার করুক। আর যারা নিরীহ তাদের সুযোগ দেওয়া হোক। আমরা যেন কাজকর্ম করে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি।”

গ্রামের আরেক নারী বলেন, “আমার স্বামী পঙ্গু। সব সময় তার শরীর কাঁপে। তাকে পুলিশ ধরলেই তার জীবন চলে যাবে। সেই ভয়ে তিনি কোথায় চলে গেছে কোনো খোঁজ নেই।”

ওই নারী আরও বলেন, “বাসায় চাল নেই। খেয়ে বাঁচার মতো কোনো ব্যাবস্থা নেই। তাই ক্ষেতে কাজ করতে যাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাই। আমরা বাঁচতে চাই।”

অপর আরেক নারী বলেন, “যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার আমরা চাই। এত বড় ক্ষতি তারা করেছে, এগুলা তো আমাদেরই সম্পদ। আমার এলাকা, আমাদের উপজেলা ক্ষতি করেছি আমরাই। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, সরকারের কাছে অনেক যন্ত্র আছে সেগুলো দিয়ে যারা প্রকৃত দোষী তাদের বের করে কঠিন শাস্তি দিক।”

“কিন্তু আমরা যে নিরীহ মানুষ। আমাদের মসজিদে আজান হচ্ছে না। রাত পোহালেই রোজা কিছুই কিনতে পারিনি। কী খেয়ে রোজা থাকব? একদিকে আমাদের ধান মাইর গেছে, আবার পাটও মাইর যাচ্ছে। আমরা কীভাবে চলব?” বলেন ওই নারী।

ওই নারী আরও বলেন, “আমার স্বামী নসিমন চালায়। কোথায় গেছে কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক সহায়তা করছে। বিধবা, বয়স্ক ভাতা থেকে শুরু করে ঘর দেওয়া, সব ধরনের সুবিধা সে আমাদের দিচ্ছে। তব আমরা আমাদের সম্পদ নষ্ট করছি। সেজন্য সবাই এখন দোষী। কিন্তু নিরীহ মানুষদের নিরাপদে থাকার সুযোগ করে দিন। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিক।”

পাটক্ষেতে কাজ করা আরেক নারী বলেন, “যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা দূরে চলে গেছে। কিন্তু এ জন্য নিরীহ মানুষগুলো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ। অভাবের সংসার কিস্তি চালাতে হয়। পুরুষ মানুষ বাড়িতে নেই, কিস্তি নেওয়ার জন্য লোকেরা বাড়িতে এসে বসে থাকে। খারাপ ব্যবহার করে।”

এদিকে সোনাপুর বাজারের এক মুদিখানা দোকানদার বলেন, “গত ৬ তারিখ থেকে দোকান করতে পারছি না।  রাতের বেলা ঘুমাতে গেলে ভয় লাগে, কখন এসে ধরে নিয়ে যায়।”

এ বিষয়ে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা বলেন, “সালথার সহিংসতার ঘটনার পর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মামলার আসামিদের ধরতে পুলিশ দিনরাত অভিযান চালাচ্ছে। তবে নিরীহ কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।”

পুলিশ সুপার আরও বলেন, “আমরা চাই না কোনো নিরীহ লোকের হয়রানি হোক। আমরা ঘটনার দিনের সংগৃহীত বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে গ্রেপ্তার করছি। তবে নিরীহ কাউকে যদি আটক করা হয় তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আতঙ্কের কিছু নেই।”

৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় করোনা মোকাবিলায় বিধিনিষেধ কার্যকর করতে লোকজনকে পেটানো হয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে সালথা থানা ও উপজেলা কমপ্লেক্সে ঘেরাও করে তাণ্ডব চালায় স্থানীয়রা। ওই তাণ্ডবের ঘটনায় ৫টি মামলা হয়েছে। এতে ২৬১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত প্রায় ৪ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।