• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২১, ১০:৪৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৭, ২০২১, ১০:৫৫ এএম

পুলিশ ফাঁড়িতে হত্যা : কবে আসবে চার্জশিট?

পুলিশ ফাঁড়িতে হত্যা : কবে আসবে চার্জশিট?

গত বছরের ১০ অক্টোবর গভীর রাতে সিলেট নগরীর কাষ্টঘর সুইপার কলোনি এলাকা থেকে রায়হান আহমদ নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে। তাকে ধরে নিয়ে যান ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর ও তার সহকারীরা। সেখানে রায়হানের ওপর কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে পাশবিক নির্যাতন। পরদিন ১১ অক্টোবর ভোরে রায়হানের নিথর দেহ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর পরদিন ১২ অক্টোবর নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১৩ অক্টোবর পুলিশ হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

আইন অনুযায়ী ১২০ দিনের ভেতর মামলার চার্জশিট প্রদানের কথা থাকলেও দীর্ঘ সাড়ে ৫ মাস অতিক্রম হলেও এখনো ওই মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই তদন্ত সংস্থাটি। এর মধ্যে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হলেও চলতি মাসের ভেতরেই চার্জশিট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদুজ্জামান।

খালেদুজ্জামান বলেন, “আমাদের তদন্ত শেষ। কিছু টেকনিক্যাল বিষয় বাকি থাকায় আমরা এগুলো শেষবারের মতো যাচাই-বাছাই করছি। এ মাসের ভেতরেই চার্জশিট দেওয়া হবে।”

এদিকে ১২০ দিনের ভিতর চার্জশিট দিতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আইনজ্ঞরা। সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, “দণ্ডবিধি অনুযায়ী ১২০ দিনের ভেতরে চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট দিতে না পারায় আমরা হতবাক। কারণ আমরা মনে করেছিলাম পিবিআই একটি পরিক্ষিত ইউনিট। সে ক্ষেত্রে তারা নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট দিতে না পারা হতাশার।”

এদিকে ঘটনার পর নির্যাতনের দৃশ্য ধারণ করা সিসিটিভির হার্ডডিস্ক গায়েব করে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ অবস্থায় নোমানকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হবে কি না তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

নিহত রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম বলেন, “সবাইকে গ্রেপ্তার করা হলো, কিন্তু নোমানকে এখনো গ্রেপ্তার করা হলো না কেন তা নিয়ে আমি সন্দিহান। নোমান যে কোথায় পালাল, তার তথ্য এখনো বের করতে পারল না পিবিআই। তাকে ধরতে তাদের এত গাফিলতি কেন, এটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।”

তিনি বলেন, “যতক্ষণ না চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ততক্ষণ কিছুই বুঝতে পারছি না। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে করে পিবিআই কেবল সময় নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই বলে এ সপ্তাহে হয়ে যাবে, আগামী সপ্তাহে হয়ে যাবে বলছে। কিন্তু তারা চার্জশিট দিচ্ছে না।”

চার্জশিট দিতে বিলম্বের কারণ হিসেবে আকবরের মোবাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি উল্লেখ করছেন পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদুজ্জামান। তিনি বলেন, “আকবরের মোবাইল থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এখন কেবল এগুলোর একটু যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকজন সাক্ষী যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল। আর করোনার কারণেও কিছু বিলম্ব হয়েছে। তবে সবকিছু শেষ। আশা করছি এ মাসেই চার্জশিট দেওয়া হবে।”

জানা গেছে, রায়হান হত্যার পর ২১ অক্টোবর এসআই হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিলেট মহানগর পুলিশ। এরপর থেকে তাকে নগর পুলিশ লাইনসে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। রায়হান হত্যার পর হাসান, আকবরসহ এ পর্যন্ত ৬ পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য চারজন হলেন এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশীদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস।

হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর ১৩ অক্টোবর মামলাটি কোতোয়ালি থানা থেকে পিবিআইয়ের কাছে স্থানান্তর করে পুলিশ সদর দপ্তর। এর আগের দিন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন।

রায়হান হত্যার পর সাময়িক বরখাস্তের পরই কৌশলে সাংবাদিক নোমানের সহযোগিতায় নগর ছেড়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে আকবর। এরপরই ভারতে পালিয়ে যায়। ৯ নভেম্বর সকালে কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে পুলিশ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে আনা হয়। পরে সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ভর্তি করা হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান।

ওই হাসপাতালেই বেলা ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সেই ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, রায়হানের মৃত্যুর ২ থেকে ৪ ঘণ্টা আগে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। সে হিসেবে ফাঁড়িতে আনার পর থেকেই তার ওপর নির্যাতন চলে।

রিপোর্টে বলা হয়, রায়হানের ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল আর বাঁ হাতের অনামিকার নখ উপড়ানো ছিল। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ কারণ ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ওই দিনই ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। পরে ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। নির্যাতনে রায়হানের হাতের দুটি আঙুলের নখ তুলে ফেলে এসআই আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর।