• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২১, ০৪:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৯, ২০২১, ০৪:৫৫ পিএম

সুন্দরবনে বাঘ সুরক্ষায় বন বিভাগের নানা পদক্ষেপ

চলতি বছরেই নতুন শুমারি, নীরবেই গেল বাঘ দিবস

চলতি বছরেই নতুন শুমারি, নীরবেই গেল বাঘ দিবস

বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশী এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা, টহল ফাঁড়ি বৃদ্ধি, চোরা শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্টোলিং চালু, প্রজনন মৌসুমে বনজসম্পদ আহরণের পারমিট বন্ধসহ বাঘ সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের সুফল হিসেবে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

এদিকে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে গত ৪ বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে ১১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৪ বছরে সুন্দরবনের বাঘ বেড়েছে ৮টি। সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪ বাঘ রয়েছে বলে ক্যামেরা ট্রাকিং জরিপে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) বিশ্ব বাঘ দিবস নীরবেই পালিত হলো।  তবে, চলতি অর্থ বছরে নতুন করে বাঘ শুমারির কার্যক্রম শুরু করেছে বন বিভাগ।

বন বিভাগের সূত্র জানান, ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিলো ৩৫০টি। এর পর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি এবং ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরপি চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।
একইভাবে ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বভিাগ। ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনরে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান। ২০০৪ সালে জরিপে বাঘরে সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে দাড়ায় ১০৬টিতে। সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১১৪ টিতে।

সুন্দরবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি। ১৪টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকী ২৫ বাঘ হত্যা করেছে চোরা শিকারীরা।

প্রাণি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস), লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থল অভাব, চোরা শিকারি, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল। এর সাথে বাঘ রক্ষায় আবাসস্থল সংরক্ষণ, বনের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের বিকাশ, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধসহ নানা সুপারিশ করেছেন তারা।

সুন্দরবন সহ ব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটির সদস্য মোঃ সাইফুল ইসলাম গাজী বলেন, লোকালয়ে আসা বাঘ নিরাপদে ফিরাতে ইতিমধ্যে ব্যাপক জন সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে এখন আর মানুষ বাঘ পিটিয়ে মারে না।

কয়রার সুন্দরবন মৎস্যজীবি সমিতির সভাপতি ইউপি সদস্য সরদার লুৎফর রহমান বলেন, সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে এটা নি:সন্দেহে খুশির বিষয়। বাঘের আবাস¯’ল সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে পারলে অবশ্যই বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধি পাবে।

কয়রা উন্নয়ন সম্বনয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, চোরা শিকারীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে বাঘ। তারা বাঘ শিকার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে। এই চক্র যাতে করে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে না পারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি সহ টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া বন্যপ্রাণী বাঘ যাতে তার স্বাভাবিক পরিবেশে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবনের পাশে যেকোন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারে সে বিষযটি নজরে আনা প্রয়োজন।

সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও জীব-বৈচিত্র নিয়ে কাজ করা ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, আশঙ্কাজনক হারে সুন্দরবনে বাঘ কমেছে। এটা বাঘের জন্য এক ধরনের হুমকি। তবে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের শর্ত সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুন্দরবনের অন্যান্য প্রাণির সাথে সাথে বাঘও স্বাভাবিক বিচরণ করতে পারবে। এর ফলে বাঘের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. এস কে আমির হোসেন বলেন, বাঘ প্রচন্ড ক্ষুধা না লাগলে লোকালয়ে আসে না। আর লোকালয়ে আসার ফলে অনেক বাঘের মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। এ কারণে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গহীন বনে বাঘের খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। যেসব অভয়াশ্রমগুলো রয়েছে সেখানের নিয়মকানুন সঠিকভাবে মানতে হবে। বন বিভাগ, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের তত্ত্বাবধায়নে কুমির ও হরিনের মত বাঘের জন্যও প্রজনন কেন্দ্র করা যেতে পারে। সেখানে বাঘের প্রজনন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। সফল হলে সেই বাঘের বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট সময় লালন পালন করে আবারও সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছেড়ে দেওয়া যাবে। এছাড়াও সুন্দরবনে মানুষের আধিপত্য কমাতে হবে। মানুষের আধিপত্য কমালে শুধু বাঘ নয়, সুন্দরবনের প্রতিটি প্রাণী বেড়ে উঠবে, আপন গতিতে।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোঃ আবু সালেহ বলেন, বর্তমান সরকার বাঘের সংখ্যা বাড়াতে নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করা হয়েছে। যার সুফল কিন্তু দেখা যাচ্ছে। বিগত তিন বছরে অনেক বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। বন বিভাগ বাঘ সুরক্ষায় যেভাবে কাজ করছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসর্ম্পপন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারীদের দৌরাত্ব কম হওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা সর্বশেষ জরিপে বেড়েছে। ইতিমধ্যেই বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশী এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে টহল ফাঁড়ি। পাশাপাশি চোরা শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রেলিং চালু করা হয়েছে। বাঘের প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগষ্ট সুন্দরবনের সকল পাশপারমিট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ বাঘ অবাধ চলাচল করতে পারবে। আতংকিত হবার কোন কারন নেই। সুন্দরবনকে বন্যপ্রাণীর জন্য সম্পূর্ন নিরাপদ করতে কাজ করছে বন বিভাগ বলে তিনি জানান।

বন্য ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগীয় কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানান, লোকালয়ে আসা বাঘ নিরাপদে ফিরাতে ইতিমধ্যে ব্যাপক জন সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে এখন আর মানুষ বাঘ পিটিয়ে মারে না। এছাড়া বাড়ানো হয়েছে টহল ফাঁড়ি। পাশাপাশি চোরা শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্টোলিং চালু করা হয়েছে। বাঘের প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগস্ট সুন্দরবনের সকল পাস পারমিট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বন সুরক্ষা পাওয়ায় বাঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সুন্দরবনের শুরু হচ্ছে বাঘ শুমারি :
বিদেশী বিশেষজ্ঞ ছাড়াই সদ্য শুরু হওয়া অর্থবছরে সুন্দরবনের বাঘ শুমারি শুরু হবে। শুমারির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। বাঘের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণি সংরক্ষণের আঞ্চলিক সহযোগিতার জোরদারকরণ প্রকল্প নেওয়া হয় । এ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাতিসহ সকল প্রাণির অবলুপ্তির অংশ হিসেবে সুন্দরবনের বাঘ শুমারি শুরু হয়।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি এলাকায় বন কর্মচারীরা বাঘের সন্ধান পেয়েছে। এবারে ভালো ফলাফল আশা করা যাচ্ছে। তিনি জানান, বিদেশী বিশেষজ্ঞ ছাড়াই এবার সুন্দরবনের বাঘ শুমারি হবে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১২ জুন ঢাকার শ্যামলী থেকে উদ্ধার হওয়া তিনটি বাঘের শাবক ডুলহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়।