• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৯, ০৩:২৬ পিএম

ধ্বংসের পথে ১৫০ বছরের পুরাকীর্তি নকিপুর জমিদার বাড়ি

ধ্বংসের পথে ১৫০ বছরের পুরাকীর্তি নকিপুর জমিদার বাড়ি
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে অরক্ষিত নকিপুর জমিদার বাড়ি

 

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় পুরাকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন নকিপুর জমিদার বাড়ি। কিন্তু সংস্কার আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা আজ ধ্বংসের পথে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটিও হতে পারে দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র্র।

সরেজমিন দেখা যায়, শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার পূর্বে জমিদার বাড়িটি। জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরীর ১৫০ বছর আগে বাড়িটি নির্মাণ করেন। এখন প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে জরাজীর্ণ ও প্রায় ভগ্নদশায়। বাড়িটি দ্রুত সংরক্ষণ করা না হলে তা দ্রুত বিলীন হয়ে যাবে।

শ্যামনগর আতরজান মহিলা কলেজের অবসারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী জাগরণকে জানান, জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী ১৮৮৮ সালে তিন তলা বিশিষ্ট এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে দুর্গামণ্ডপ, নহবতখানা, শিবমন্দির ও জলাশয়সহ বিভিন্ন নির্দেশন। যা দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত জৌলুস। রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে হরিচরণ রায় ছিলেন শ্যামনগর অঞ্চলের প্রভাবশালী জমিদার। তিনি সাতক্ষীরা জেলাব্যাপী রাস্তা, খাল খনন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নকিপুর মাইনর স্কুলটি নির্মাণ করেন (যা বর্তমানে নকিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত)।

তিনি আরো জানান, ১৯৭১ সালে জমিদার বংশের লোকজন ভারতে চলে যান। পরে জমিদার বাড়ির বিভিন্ন দামি জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। একইসঙ্গে বাড়িটি দখলে নেয় কিছু ভূমিদস্যু। তবে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পাশের দুর্গামণ্ডপ, নহবতখানা, শিবমন্দির, জলাশয় ইত্যাদি দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত সৌন্দর্য। দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকায়। তার বংশের রাজত্ব প্রায় ২৫০ বছর ছিল। পরে জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী শ্যামনগরের নকিপুরে একছত্র অধিপতি ছিলেন। শ্যামনগরে সদ্য জাতীয়করণকৃত নকিপুর এইচ.সি (হরিচরণ চৌধুরী) পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অরক্ষিত পুরাকীর্তির নিদর্শন এই জমিদার বাড়িটি অতি দ্রুত সংরক্ষণের দাবি জানান।

লেখক ও শিক্ষক চারু চন্দ্র মণ্ডলের লেখা বই থেকে জানা যায়, সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরীর বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। যার সীমানা প্রাচীর ছিল প্রায় দেড় হাত চওড়া। মূল ফটকে নির্মিত ছিল সিংহদ্বার আকৃতির গেট। সম্মুখে একটি শান বাঁধানো বড় পুকুর যা ১০০ বছর আগে খনন করা হয়। এই পুকুরে সারা বছরই পানি থাকত। গ্রীষ্মের দিনে প্রচণ্ড তাপদাহেও পানি শুকাতো না। পুকুরঘাটের বাম পাশেই রয়েছে ৩৬ ইঞ্চি সিঁড়ি ও আটটি স্তম্ভ বিশিষ্ট বিশিষ্ট দ্বিতল নহবত খানা। বাগান বাড়িসহ মোট বার বিঘা জমির উপর বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত। ৭০ গজ লম্বা, তিন তলা বিশিষ্ট ভবনের সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সম্মুখে সিঁড়ি ঘর। নিচের তলায় অফিস ও নানা দেবদেবীর পূজার ঘর। এছাড়া যাতায়াতের জন্য আরও দুইটি সিঁড়ি রয়েছে। বাড়িটির মাঝের তলায় কুল দেবতা গোপাল দেবের মন্দির ও অতিথি শালা।

মাঝ খান দিয়ে যাওয়ার সিঁড়ির দুই পাশে কক্ষ ছিল। আর আট ফুট চওড়া সদর ও অন্দরের দুই পাশে আকর্ষণীয় বারান্দা। বাড়িটির তলায় একাধিক কক্ষ রয়েছে। সেগুলো ভাড়ার ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হতো বলে ধারণা করা হয়। নিচের তলায় ১৭টি এবং উপরের তলায় ৫টি ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজে কক্ষ আছে। ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাঁদ, ২১০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৩৭ ফুট প্রস্থ এবং পুন: ৬৪ ফুটের মাথায় এল প্যাটানে নির্মাণের কারণে জমিদার বাড়িতে প্রথমবার ঢুকলে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টদায়ক ছিল। ভিতরে ছিল চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন এবং লৌহ কাঠের দরজা-জানালা। লোহার কড়িতে আকর্ষণীয় বাড়িটিতে প্রবেশ করার জন্য ২০ ফুট অন্তর ৪টি মেইন গেট রয়েছে। এছাড়া জমিদার বাড়ির দক্ষিণে আরো একটি বড় পুকুর ছিল (বর্তমান পুকুরটি আর নেই) তবে তার দক্ষিণ পাশে খননকৃত শান বাঁধানো একটি পুকুর আছে। যার ঘাটের দুই পাশে দুটি শিব মন্দির রয়েছে। ১৯৫৪ সালে জমিদাররা স্ব-পরিবারে ভারতে চলে যায়।

শ্যামনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুজন সরকার জানান, এর মধ্যে জমিদার বাড়িটির অবৈধ দখলমুক্ত বা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে আদালতে মামলা থাকায় একজনকে উচ্ছেদ করা যায়নি। এর আগে সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ স্ব-স্ব উপজেলার ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থান সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ অনুযায়ী নকিপুর জমিদার বাড়িটি অবৈধ্য দখল মুক্ত করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করা চলছে। তবে ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি পূর্বের নান্দনিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জাগরণকে জানান, শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর জমিদার বাড়িটি পুরাকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন এবং জেলার দর্শনীয় স্থান। দেড়শ বছর আগের জমিদার বংশের গৌরবময় ঐতিহ্যের নানা নির্দশন রয়েছে এ বাড়িতে। জেলা প্রশাসন জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণে এর মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে।


এসসি/