• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:২৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:২৯ এএম

স্বাস্থ্যখাত থেকে টাকা লোপাটের হোতা মিঠুচক্র

স্বাস্থ্যখাত থেকে টাকা লোপাটের হোতা মিঠুচক্র
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোগো

● অবৈধ পন্থায় টাকা লোপাটের নেশায় মত্ত মিঠু চক্র
● মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিন পরিচালক
● ভুয়া ভাউচারে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

স্বাস্থ্যখাতে সরকারি টাকা লোপাটের সাথে জড়িত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু ও তার সংঘবদ্ধ চক্রের দৌরাত্ম্য কমে নি। বাংলাদেশের এমন কোনও সরকারি হাসপাতাল নেই, যেখানে মিঠুর এজেন্ট নেই। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হকের আমলে মিঠুর কু-কীর্তি একের পর এক ফাঁস হতে থাকে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আমলেও মিঠুর নড়াচড়া ছিল। আর বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আমলেও সরকারি অর্থ লোপাট থেকে থেমে নেই। প্রতিনিয়ত টাকা লোপাটের নেশায় মত্ত মিঠু ও তার চক্র।

মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারের যে কোনও শ্রেণির কর্মকর্তাকে মিঠু যে কোনও কিছুর বিনিময়ে ম্যানেজ করতে জানেন। এটাই তার বড় শক্তি। বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি করে দেয়া, বিলাসবহুল আসবাবপত্র কিনে দেয়াসহ অবৈধ কাজের জন্যও মিঠু সুযোগ করে দেন হর্তাকর্তাদের। 
সম্প্রতি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ভুয়া ভাউচারে জাল-জালিয়াতি করে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে মিঠু চক্রের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবদুল গনিকে ওএসডি করা হয়। 

গত কয়েক মাসের ব্যবধানে সারা দেশ থেকে একই কায়দায় অন্তত ২০০ কোটি টাকা মিঠু চক্র লোপাট করেছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্রের চাহিদাপত্র তৈরি, কার্যাদেশ দেয়া, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা এবং তা বুঝে নেয়ার প্রতিটি জায়গায় চরম অসঙ্গতি ধরা পড়ছে সরকারের কাছে। হাসপাতালের জন্য একাধিক যন্ত্রপাতি জাপান, ইতালি, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এনে সরবরাহের কথা হয়। কিন্তু তা করে না মিঠুর ঠিকাদার সিন্ডিকেট।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই অর্থ পরিশোধের বিল স্বাক্ষরে সময় লেগেছে মাত্র চার দিন। বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কোম্পানি নাম ব্যবহার করে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। আর রংপুরে তাকে সহায়তা করেন হাসপাতালের কর্মচারীদের সরদার নোমান। রংপুরে মিঠু ও নোমানের নেতৃত্বে চার খলিফা নামে বিশাল একটি ঠিকাদারি সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সিন্ডিকেট মালামাল সরবরাহ ছাড়াও রংপুর শহরে অবস্থিত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরকারি ওষুধও সরবরাহ করে।

সূত্র জানান, চলতি বছর জুনের ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখে ওই বিলের ফাইলে স্বাক্ষর করা হয়। এরপর সেগুলোর চেক ইস্যু করা হয়। জুন ক্লোজিংয়ে কেনাকাটার জন্য বাজেটের নির্ধারিত টাকা ফেরত যাওয়ার আগে এসব করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ঠিকাদার মিঠুর যোগসাজশে। গত ২৭ জুন সংসদীয় কমিটির একটি সভায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন হাসপাতাল পরিচালক ডা. আবদুল গনি। ২৮ জুন রংপুরে ফিরে তিনি অসুস্থ হলে বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। তখন পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ। চিকিৎসা শেষে ডা. গনি ৯ জুলাই কাজে যোগদান করেন। যোগদানের পরই তার বিরুদ্ধে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ৬৩ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনায় নির্দেশ অমান্যের অভিযোগ আনে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ১৪ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে ওএসডি করা হয়।

দেশের স্বাস্থ্যখাত জুড়ে রয়েছে মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। যারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচরার মহিপুর ইউনিয়নে। মিঠু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাতের টেন্ডার। দেশের স্বাস্থ্যখাতের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনও তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনও হুমকি-ধামকির মাধ্যমে।

মিঠু ও তার সিন্ডিকেট দেশের স্বাস্থ্যখাতে যে হরিলুটের রাজত্ব তৈরি করে, তা আগে কখনই ছিল না। হাসপাতাল পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কেউ নন, মিঠু ও তার সিন্ডিকেট নির্ধারণ করে দিতেন, কোন হাসপাতালে কোন যন্ত্রপাতি লাগবে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের আমলে অবস্থা এমনও হয়েছিল মিঠু ও তার সিন্ডিকেটের কথায় হাসপাতালের মেশিন কেনাকাটা হতো।  অকারণে যন্ত্রপাতি সরবরাহ, মালামাল সরবরাহ না করে ভূয়া কাগজ দিয়ে বিল উত্তোলনের মতো লঙ্কা-কাণ্ড ঘটাতে সিদ্ধহস্ত মিঠু একসময় নিজে বিভিন্ন কর্মকর্তার টেবিলে যেতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তাকে যেতে হচ্ছে না। কারণ তার স্বাস্থ্যখাতের সরকারি অফিসগুলোয় তার এজেন্ট হয়ে গেছে অসংখ্য। পান থেকে চুন খসলেই খবর চলে যায় তার কাছে। মিঠু কোথায় থাকেন- সেটাও বলা মুশকিল। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের আমলে মিঠু কু-কীর্তি যখন ফাঁস হতে থাকে, তখন থেকেই মিঠু চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। পরিস্থিতি বেগতিক মনে করলে চলে যান বিদেশে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আমলেও তার রাজত্ব ছিল। এসময়ও বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ কেলেঙ্কারিতে মিঠুর নাম বেরিয়ে আসে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিনজন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। তারা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেছেন। যাদের একজন অবসরে গেছেন। মন্ত্রী-সচিবসহ স্বাস্থ্যখাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া নিচের পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। এই সিন্ডিকেটের কারণেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল শিক্ষা শাখার আবজাল হোসেন এত অর্থ সম্পত্তির মালিক হন। যাকে সম্প্রতি তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আবজালের বিপুল সম্পত্তির কথা বেরিয়ে আসার পর পিলে চমকে যায় দুদক।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভায় বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন ঠিকাদারির কাজ না করেই বিল করে টাকা তুলে নেয়ার দিন শেষ। প্রতিটি হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব ঠিকাদারি কাজের গুণগত মান বুঝে নিয়ে তারপরই ঠিকাদারদের সব বিল পরিশোধ করতে হবে। অযৌক্তিক বা ভৌতিক কোনও বিলে কোনভাবেই স্বাক্ষর করা যাবে না।

সেই সভায় উপস্থিত একটি হাসপাতালের পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দৈনিক জাগরণকে বলেন, কিছু হাসপাতালের পরিচালক মিঠুর বিষয়ে মন্ত্রীকে অবহিত করেন। রংপুর মেডিকেল, ফরিদপুর মেডিকেলের একই রকম ঘটনাও আছে। এসবের প্রেক্ষিতে মন্ত্রী ওই কথা বলেন।
মিঠুর বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সাথে। কিন্তু তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় নি।

আরএম/এসএমএম
 

আরও পড়ুন