• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০১৯, ০৯:৫৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২, ২০১৯, ০৯:৫৭ পিএম

সমঝোতায় খালেদা জিয়ার মুক্তি!

সমঝোতায় খালেদা জিয়ার মুক্তি!
খালেদা জিয়া - ফাইল ছবি

অবশেষে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রশ্নে সমঝোতার পথে হাঁটছে দলটি। বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের গত দুদিনে দৌড়ঝাঁপ ও দলীয় নেতাদের বক্তব্যে এ আভাস পাওয়া গেছে। যদিও প্রকাশ্যে কেউ সমঝোতার কথা স্বীকার করছেন না। 

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দেড় বছর ধরে কারাবাসে রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তার মুক্তি প্রশ্নে বিএনপি ও দেশের রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা, গুজব-গুঞ্জন ঘুরপাক খেতে থাকলেও এখনও পর্যন্ত তা কোনো সমাধানে আসেনি। আইনি প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রধানের মুক্তিতে ব্যর্থ হয়ে এরইমধ্যে দলটি আন্দোলনের পথেও নেমেছে। এর অংশ হিসেবে এরইমধ্যে তারা দেশের বেশ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন হিসেবে সমাবেশ, প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- যে মামলায় দেশের সাবেক তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রী কারাবাস করছেন, তা নিছকই জামিনযোগ্য একটি মামলা হলেও সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে তিনি জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন না। এটা অবশ্যই আইন ও আদালতের প্রতি সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- বিএনপি প্রধানের কারাবাসের পেছনে সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ নেই। এটা সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। আদালত তাকে জামিন দিলে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না।   

এসব অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের পর হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়টি সামনে এসেছে। চলতি সংসদের বয়স ৯ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর দলীয় প্রধানের মুক্তি প্রশ্নে ‘হঠাৎ সরব’ হয়ে উঠেছেন বিএনপি দলীয় ৭ সংসদ সদস্য। এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গত মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) বিএনপির সংসদীয় দলের প্রধান হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে তিন সংসদ সদস্য বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের কেবিনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় তারা দলীয় প্রধানের সঙ্গে কাটিয়ে বাইরে এসে গণমাধ্যমের কাছে তার শারীরিক অসুস্থতার বর্ণনা দেন এবং দ্রুত জামিনে মুক্তির দাবি জানান। একইসঙ্গে এ তিন সংসদ সদস্য জানান, জামিনে মুক্তি পেলে যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও যাবেন।
বুধবার (২ অক্টোবর) বিকালে খালেদা জিয়ার নিজের সংসদীয় আসন বগুড়া-৬ থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য জিএম সিরাজের নেতৃত্ব চার সংসদ সদস্য বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন দলীয় প্রধানকে দেখতে যান। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী খালেদা জিয়ার কেবিনে সাক্ষাৎ শেষে তারা বাইরে এসে গণমাধ্যমের কাছে তার নাজুক শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দেন। দেশের তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিতে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। 

জাতীয় সংসদ চলমান হওয়ার ৯ মাস পর বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের এই দৌড়ঝাপে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কি শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছেন খালেদা জিয়া? কারণ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানায়। এরপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দলের নির্বাচিত সদস্যরা শপথও গ্রহণ করে। তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর হয়ে ওঠে, দলীয় প্রধানের কারামুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথ হিসেবেই বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন।

জানা গেছে, খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়ে আগের চেয়ে সরকার অনেকটা নমনীয়। যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বুধবার সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি খালেদা জিয়া জামিন পেলে যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, সে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। বিএনপির সংসদ সদস্যগণ নিজেরাও প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন। তিনি বলেন, জামিন পেলে চিকিৎসকরা যদি খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দেন, তখনই সরকার বিষয়টি দেখবে। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের ‘কোনো শত্রুতা নেই’।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে ‘সমঝোতার’ পথে হাঁটছে বিএনপি। যেকোনো মূল্যে দলটি তার মুক্তি নিশ্চিতের জন্য কাজ করছে। দলীয় এবং দলের সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে এমন ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় সংসদ সদস্যরা এরইমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগযোগ করেছেন। এর অংশ হিসেবে বুধবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সচিবালয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন।

জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন জানানো হবে। দলীয় সংসদ সদস্যরা আলোচনা করে চিঠি দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। তবে এই বিষয়ে এখনই কেউ মুখ খুলতে নারাজ।
  
খালেদা জিয়ার পছন্দসই হাসপাতালে দেশেই চিকিৎসার জন্য প্যারলের আবেদন করছেন, না কি জামিনে মুক্তি মিললে বিদেশে চিকিৎসা নেবেন- এমন প্রশ্ন দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকলেও দলীয় সংসদ সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করার পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তাদের দাবি, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় এখনই তাকে বিদেশে পাঠানো উচিত। যে কোনো মূল্যে তারা দলীয় প্রধানের মুক্তি চান।   

গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে হারুনুর রশীদের বক্তব্যেও এরই ইঙ্গিত দেন। হারুন বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। জামিনে মুক্তি পেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন তিনি।

খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে দেখে আসার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দৈনিক জাগরণকে বলেন, সংবিধানেই বলা আছে, একজন বয়স্ক নারী ও শিশু জামিনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। তাই সাংবিধানিকভাবেই খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সরকার নানা কৌশলে তার জামিন দিচ্ছে না।

খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া প্রসঙ্গে আলাল বলেন, উনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক যে অবস্থা, তাতে দ্রুত চিকিৎসা দরকার। সেটা নিয়েই হয়ত আলাপ-আলোচনা চলছে। আমরা এটা নিয়ে কোনো রাজনীতি করতে চাই না। 

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়া সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বা সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে প্যারল নিতে চান না। কিন্তু এখন দলের স্বার্থে দলীয় প্রধানের শারীরিক অবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করে প্যারল নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলীয় সংসদ সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছেন। বর্তমানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বিএনপিতে উদ্বেগ বেড়েছে। আর প্যারলে মুক্তি হলেও কোনো আপত্তি নেই তাদের, এমনটাও জানা গেছে। 

বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার দৈনিক জাগরণকে বলেন, এই মুহূর্তে নেত্রীর মুক্তি প্রয়োজন। তাকে চিকিৎসা দিতে হবে, যে চিকিৎসা এখন আর বাংলাদেশে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দলীয় সংসদ সদস্যরা বসে আলোচনা করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির ৪ সংসদ সদস্য     - ছবি : জাগরণ

বুধবার বিকালে বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য জিএম সিরাজের নেতৃত্বে বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান জাহিদ, বগুড়া-৮ আসনের সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দৈনিক জাগরণকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বলেন, আমাদের নেত্রী যে মামলায় কারাবন্দি রয়েছেন, তা অবশ্যই জামিনযোগ্য একটি মামলা। আইন নিজস্ব গতিতে চললে বেশ আগেই জামিন পেতেন। কিন্তু একথা তো সত্যি যে, দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বপন বলেন, পর্দার আড়ালে তো অনেক গেইমই চলে। ম্যাডামের শিগগিরিই মুক্তির বিষয়ে আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য নেই। রাতে (বুধবার) আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে আমার দেখা ও আলাপ হবে। এরপর এ বিষয়ে জানতে ও বলতে পারব। 

দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ড নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে রয়েছেন। ৭৪ বছর বয়সী খালেদাকে চিকিৎসার জন্য গত ১ এপ্রিল থেকে রাখা হয়েছে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে।

সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে খালেদার বিরুদ্ধে এখন ১৭টি মামলা বিচারাধীন। আইনজীবীদের ভাষ্য, এর মধ্যে দুটি মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) জামিন পেলেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

টিএস/ এফসি

আরও পড়ুন