• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৯:৪৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৯:৪৮ এএম

টং দোকানি থেকে বিশাল সম্পদের মালিক কাউন্সিলর রাজীব

টং দোকানি থেকে বিশাল সম্পদের মালিক কাউন্সিলর রাজীব
বিভিন্ন বেশভূষায় তারেকুজ্জামান রাজীব-ছবি : সংগৃহীত

মোহাম্মদপুরের বাঁশতলা এলাকায় সামান্য টাকায় ভাড়ায় থাকতেন রাজীব। চালাতেন টং দোকান। সে দোকানে রাজীব বিক্রি করতেন চা-পান সিগারেট। এ স্বল্প আয় দিয়ে তাদের সংসার চলতো কোনও মতে। তবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপকর্মের মাধ্যমে কয়েক বছরেই বনে যান শত শত কোটির টাকার মালিক। বেপরোয়া দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, নির্যাতনের মাধ্যমে গড়ে তোলেন অপরাধ সামাজ্য। তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কাণ্ডের পাশাপাশি জমি, বিলাসবহুল বাড়ি দখলের অভিযোগও রয়েছে। চলাফেরা করেন নামি-দামি ব্র্যান্ডের বিলাস বহুল গাড়ি হাঁকিয়ে। সঙ্গে থাকে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। মন্ত্রী না হলেও চলেন ক্যাডার বাহিনী বেস্টনিতে ভিআইপি স্টাইলে।

জানা গেছে, সিটি করপোরেশন থেকে কাউন্সিলর হিসেবে মাসে ৩৬ হাজার টাকা সম্মানি ছাড়া আর কোনও দৃশ্যমান বৈধ আয় নেই র‌্যাবের হাতে আটক ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজীবের। মোহাম্মদপুরবাসীদের প্রশ্ন, তার অঢেল ধন-সম্পত্তির উৎস কোথায়?

২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে জয়ী হওয়ার পর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তারেকুজ্জামান রাজীবের। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন এই যুবলীগ নেতা। দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন তিনি। তারপর থেকে মোহাম্মদপুরের বসিলা, আদাবর ও সাত মসজিদ কাটাসুর এলাকায় অপরাধের দুর্গ গড়ে তোলেন রাজীব।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, তার রয়েছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যরা হচ্ছেন- যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবন, কামাল হোসেন ওরফে সিএনজি কামাল, আশিকুজ্জামান রনি, ফিরোজ আহমেদ, ফারুক হোসেন, রাজীবের শ্যালক ইমতিহান, জাকির হোসেন উকিল, শাহিন আহমেদ ও নাজমা বেগমসহ আরও কয়েকজন।

জানা গেছে, কাউন্সিলর হওয়ার পরই রাজীবের লোকজন পাইন আহমেদ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর করে। ওই ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার হয়। পরে ওই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তিনি মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তবে শনিবার রাতেই গ্রেফতার হওয়ার পর যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। 

রাজীবের ঘনিষ্টজনরা দৈনিক জাগরণকে জানায়, কাউন্সিলর হওয়ার পর তার নামের ভিন্নতা নিয়ে আসেন রাজীব। তারেকুজ্জামান রাজীব থেকে টি জেড রাজীব। এরপর লায়ন টি জেড রাজীব বনে যান এই কাউন্সিলর। পরে নামের পাশ থেকে লায়ন শব্দটি সরিয়ে নিয়ে বনে যান টি জেড রাজীব।

স্থানীয়দের ভাষ্য, রাজীবের ডানহাত শাহ আলম চৌধুরী জীবন একসময় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সুপার মার্কেটের সোয়েটার কারখানার কর্মচারী ছিলেন। যুবলীগে যোগ দিয়ে বনে যান জনতার নেতা। রাজীবের হয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী লালন, জমি দখল করেন তিনি। কাটাসুর এলাকায় শাহ আলমের কার্যালয়। যে জমিতে তিনি আলিশান কার্যালয় গড়ে তুছেন তা কোনও সরকারি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। জমি দখল করে সেখানে কার্যালয় গড়েছেন এই যুবলীগ নেতা। গণমাধ্যমে রাজীবের অপকর্মের প্রতিবেদন প্রকাশ হলে এলাকা ছাড়ে রাজীবের ডান হাত শাহ আলম চৌধুরী জীবন। শাহ আলমের মতো রাজীবের আরেক শক্তি কামাল হোসেন ওরফে সিএনজি কামাল। সেও আত্মগোপনে। বসিলার বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড় এলাকায় রয়েছে তার একটি রাজনৈতিক কার্যালয়। সেখানে তিনি নিয়মিত বসতেন। বেড়িবাঁধে ইজিবাইক থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হয় সিএনজি কামালের নির্দেশে। বসিলা যাওয়ার সড়কের সামনে থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড হানিফ কোম্পানির বাড়ির সামনে সরিয়ে আনা হয়েছে কাউন্সিলর রাজীবের নির্দেশে। আর এসব অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন তোলা হয় বিপুল পরিমাণ চাঁদা। চাঁদা আদায় হয় বেড়িবাঁধ সড়কে চলাচলকারী লেগুনা ও বাস থেকেও। বসিলা নতুন রাস্তার ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোর হর্তাকর্তাও কামাল। দোকান প্রতি এককালীন এক থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে সড়ক দখল করে হকার বসিয়েছেন কামাল। প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন আদায় হয় এক থেকে দেড়’শ টাকা হারে। এখানে দোকান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। এ সব চাঁদার টাকা চলে যায় রাজীবের হাতে।

ক্যাসিনো কাণ্ডের হোতাদের গ্রেফতার অভিযান শুরুর পর থেকে এলাকা দাঁপিয়ে বেড়ানো যুবলীগ নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের কার্যালয় ও এর আশপাশ খাঁ খাঁ করছে। নেই কোনও নেতা-কর্মী। কার্যালয়ে তালা ঝুঁলছে। চিত্র পাল্টে গেছে বসিলা বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়ের সিএনজি কামালের কার্যালয়েরও। যেখানে গভীর রাত পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের আনাগোনা ও আড্ডা ছিল, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। কার্যালয় বন্ধ। রাজীবের ডান হাত হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবনের কাটাসুরের কার্যালয়ও তালাবদ্ধ। স্থানীয় লোকজন জানান, কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে নেতা-কর্মীদের যে সার্বক্ষণিক ভিড় লেগে থাকত, এখন আর তা দেখা যায় না। কয়েকদিন ধরেই বন্ধ। শুধু তাই নয়, নেতা-কর্মীদের দেখা নেই বসিলা রোডের যুবলীগ কার্যালয়েও।

বসিলা নতুন রাস্তার পাবলিক টয়লেটের পাশের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ঢেকে দেয়া হয়েছে সাদা কাপড় দিয়ে। সেখানেও নেই কোনও নেতা-কর্মী।

ক্যাসিনো কাণ্ডে নাম আসার পরই লাপাত্তা হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব।

আঙুল ফোলে কলাগাছ

রাজীব কাউন্সিলর হওয়ার পর বছর চারেকেই আঙুল ফোলে কলাগাছ হয়েছেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ শত কোটি টাকা। নিজেকে জনতার কমিশনার আখ্যা দেয়া রাজীবের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ উঠছে একের পর এক। একই সঙ্গে চাঁদা আদায় করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করার জন্য গড়ে তোলেন বেশ কয়েকটি দল। একেকটি দল একেক ক্ষেত্রে রাজীবের হয়ে কাজ করত। গা ঢাকা দিয়েছেন এসব নেতাকর্মীও।

গত ১২ অক্টোবর থেকে খোঁজ মিলছিল না ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজীবের। তার বাড়িসহ সম্ভাব্য সব জায়াগায় তার দেখা মেলেনি। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও ফোনও ধরছিলেন না এই জনপ্রতিনিধি। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল রাজীব র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন। দুই দিন পর শোনা যায়, তিনি পুলিশের কোনও বড় কর্মকর্তার সহযোগিতায় পুরান মামলায় স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। যাতে করে শুদ্ধি অভিযানে র‌্যাব তাকে আটক করতে না পারে। কিন্তু শনিবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪০৪ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব সদস্যরা রাজীবকে আটক করে। রাত ৩টায় তার মোহাম্মদপুরের বাড়িতে অভিযান চালোনো হয়। 

এরই মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে রাজীবের ক্যাডার বাহিনীর আশিকুজ্জামান রনি, ফিরোজ আহমেদ ফিরোজ, ফারুক ও রাজীবের শ্যালক ইমতিহান হোসেন ইমতি। তাদের দেখা নেই কয়েকদিন ধরে। ভূমি দখলদার, সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী লালনকারী হিসেবে পরিচিত এলাকায় তারা। গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছে আরও কয়েকজন নেতা।

বেড়িবাঁধের পশ্চিমে ওয়ার্ডের বর্ধিতাংশের একটি এলাকা সাত মসজিদ হাউজিং। এ এলাকার ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করেন জাকির হোসেন উকিল। জাকির চাঞ্চল্যকর বসির হত্যা মামলার প্রধান আসামি। দীর্ঘদিন জেল হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে ডিশ ব্যবসা করার পাশাপাশি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের ওপর আবার কর্তৃত্ব স্থাপন করে এই নেতা। গণমাধ্যমে রাজীবের কর্মী হিসেবে তার নাম আসায় শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) থেকে এলাকা ছাড়া সে। ছিনতাইকারী নিয়ন্ত্রকদের আরেকজন নাম শাহিন। জমি দখলে রাজীবকে সহযোগিতা করতেন নাজমা বেগম নামে এক নারী। তিনিও গ্রেফতার এড়াতে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।

এইচএম/এসএমএম

আরও পড়ুন