• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০১৯, ০৯:৫০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৪, ২০১৯, ১০:০৯ এএম

জঙ্গি প্রধান মেজর জিয়া কোথায়? 

জঙ্গি প্রধান মেজর জিয়া কোথায়? 
বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক -ছবি : সংগৃহীত

তার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। সংক্ষেপে মেজর জিয়া। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। সর্বশেষ তিনি মিরপুর সেনানিবাসে থাকতেন। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দফতরের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই মেজর জিয়া।

সেই মেজর জিয়া এখন দেশের মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। জঙ্গি তৎপরতায় যোগ দিয়ে হয়ে গেছেন অন্যতম নেতা। নব্য জেএমবি থেকে শুরু করে এবিটি পর্যন্ত সকল জঙ্গি গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এই মেজর জিয়া। গত ১৫ বছরে তার নির্দেশনায় দেশি-বিদেশি নাগরিক, ইমাম, পুরোহিত, সুশীল সমাজের লোকজন এবং ব্লগারসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির প্রাণ নিয়েছেন জঙ্গিরা। এ সকল খুনের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় ১২০০ জঙ্গি গ্রেফতার করেছে। তাদের বেশিরভাগই  রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক রয়েছেন। কিন্তু জঙ্গিদের নেতা  মেজর জিয়ার খোঁজ কেউ দিতে পারছেন না। র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন অভিযান চালিয়েও ১৫ বছরেও তার হদিস মেলে নি।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, জঙ্গি নেতা মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের জন্য আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থা তৎপর রয়েছে। 

সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত এই মেজর জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পালিয়ে কোথায় আত্মগোপনে রয়েছে, এখনও তিনি জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত কি না, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত জঙ্গির স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, বহু হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত তিনি। দেশজুড়ে চলা বিভিন্ন অভিযানের পরও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নি। 

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এবিটির মাঠপর্যায়ের জঙ্গি আসাদুল্লাহকে গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে, মেজর জিয়া বেশিরভাগ সময় চট্টগ্রাম এলাকায় থাকেন। গ্রেফতার হওয়ার ক’দিন আগেও নাকি মেজর জিয়ার সঙ্গে ওই জঙ্গির দেখা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মেজর জিয়া সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। মিরপুর সেনানিবাস থেকে বের হয়েই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মিজানুর রহমান দৈনিক জাগরণকে জানান, আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) এই জঙ্গি নেতাকে হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করা গেলে অনেক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

র‌্যাব-পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চাকরিচ্যুত হওয়ার পরই মেজর জিয়া সরকার উৎখাত, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে নানা অপতৎপরতায় যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাওহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারবিরোধী তৎপরতায় শুরু করেন জিয়া। একপর্যায়ে তিনি এবিটির সামরিক শাখার প্রধান হন মেজর জিয়া। তার পর পরেই দায়িত্ব নেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) বিভিন্ন কিলিং স্কোয়াডের। নব্য জেএমবির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। কোমলমতি তরুণদের বিপথগামী করতে থাকেন তিনি। এবিটির মধ্যেই সৃষ্টি করেন আটটির বেশি কিলিং স্কোয়াড। তাদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তমনা ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার মিশনে নামেন তিনি। এসব হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া। জাগৃতির প্রকাশক দীপন হত্যা মামলা এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার চার্জশিট সম্প্রতি আদালতে দাখিল করেছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম।  

চার্জশিটে জঙ্গিদের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, অন্তত ৯টি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন মেজর জিয়া। আরও বেশ ক’জনকে হত্যার পরিকল্পনা রয়েছে তার। জিয়ার বেশ কয়েকজন সহযোগী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলে আত্মগোপনে চলে যান জিয়া।

২০১৩ সালের আগস্টে গ্রেফতার হন এবিটির কথিত ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ জসিম উদ্দিন রাহমানী। তিনি বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় এই মেজর জিয়ার। কথিত গুরু জসিম গ্রেফতার হওয়ার পরেই মূলত আলোচনায় আসে জিয়ার নাম। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী জসিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পায়, মেজর জিয়া এবিটির সামরিক শাখার দায়িত্ব নিয়েছেন। জসিম গ্রেফতারের আগে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। ওই মামলায় জসিমের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, মেজর জিয়া এবিটির হাল ধরেছেন। জঙ্গিবাদী এই সংগঠনকে শুধু সামরিক সহযোগিতা নয়, আর্থিক সহযোগিতাও দিয়ে আসছেন মেজর জিয়া।

২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও দুইজন এনজিওকর্মী খুন হন। এসব খুনের সঙ্গে এবিটি জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় অন্তত বিজয় দাশ, আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন ও রাজধানীর গোড়ানে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজন এনজিও কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

রাজধানী ও আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তাদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, মেজর জিয়া এসব হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে মেজর জিয়া সম্পর্কে।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ওইদিনই বিকেলে তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৬ সদস্যকে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়। সুনামগঞ্জের মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, কুমিল্লার আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে স্বাদ, চট্টগ্রামের খারুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান ও শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের, লালমনিরহাটের আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, ময়মনসিংহের মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন স্বীকারোক্তি দেয়, জিয়াই এসব হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। 

অভিজিৎ হত্যা মামলায় চার্জশিটে মেজর জিয়া ছাড়াও অন্য আসামিরা হলো- আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব (৩৪), মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার (২৫), আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম (২৪), শফিউর রহমান ফারাবী (২৯) ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ৩০)। এদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক।  

অভিজিৎ রায়কে কিভাবে হত্যা করা হয় ও কারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় আবু সিদ্দিক সোহেল আদালতে তার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সোহেল বলে, ২০১৪ সালে সে এবিটির সদস্য হয়। পরে মেজর জিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে জিয়া ও আবিরের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়। জিয়াই তাদের টিমকে অভিজিৎ হত্যার নির্দেশ দেন। কিভাবে হত্যা করতে হবে তারও রূপরেখা দেন তিনি। সায়মন ও হাসান একই ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়েছে। 

এনজিও কর্মকর্তা জুলহাস-তনয়, অনন্ত বিজয়, দীপন হত্যাকাণ্ডও এই মেজর জিয়ার নির্দেশে হয় বলে গ্রেফতারকৃত জঙ্গি সদস্যরা জবানবন্দি দিয়েছে। 

একেক সময় একেক বেশে জিয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে তার সহযোগীরা গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। 

এইচএম/এসএমএম

আরও পড়ুন