• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২০, ০৯:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৮, ২০২০, ১২:০০ পিএম

কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না ধর্ষকদের

কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না ধর্ষকদের
এই নারীর মতো নিরাপদ বাংলাদেশ চান দেশবাসীও-ছবি : সংগৃহীত

বি শে ষ  প্র তি বে দ ন

.....

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে ধর্ষণকাণ্ড। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না ধর্ষকদের। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সচেতনতা বাড়লেও একের পর এক ধর্ষণ হচ্ছেই। ধর্ষণ এখন আর কোনও শ্রেণির মধ্যে নেই, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণির মানুষ এবং কোনও বয়সের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নেই। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না নিজের সন্তানও। ৩ বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের নারীরাও বাদ যাচ্ছে না। রেহাই পাচ্ছেন না বাকপ্রতিবন্ধী বা ভবঘুরে পাগলিনীও। বোরকা পরা নারীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।

ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় সংসদে এ নিয়ে কথার ঝড় তুলেছেন সংসদ সদস্যরা। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ধর্ষককে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ক্রসফায়ার’-এ দেয়ার দাবি জানিয়ে জাতীয় সংসদের সরকার ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সদস্য বক্তব্য রেখেছেন। যদিও এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।

সমাজ সংস্কারক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধর্ষণকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিকৃত মানসিকতা। আর নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হলো নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা। এমন মানসিকতাই নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।

ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, অবাধ আকাশ-সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও।

গত পাঁচ বছর সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশুরাই বেশি ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে

............................................................

সম্প্রতি রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ষককে গ্রেফতার করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল লক্ষ করার মতো। কিন্তু এই তৎপরতার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জে পাশবিকতার শিকার হয়েছে এক শিশু। ঘটনাটি গত রোববারের হলেও বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর জানা যায় সব।

ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, পান আনার কথা বলে নিজ কক্ষে নিয়ে ৮ বছরের ওই শিশুকে ধর্ষণ করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের সিদ্দিক নামের এক ব্যক্তি। অভিযুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় শিশুটির পরিবার ঘটনাটিকে গোপন রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শিশুটির অবস্থা গুরুতর হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এক কিশোরীকে দল বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাতে টঙ্গী থেকে সুনামগঞ্জ যাচ্ছিলেন ওই কিশোরী। বাস পরিবর্তনের জন্য ভৈরবে নামেন। এ সময় এক ইজিবাইক চালক সুনামগঞ্জের বাসে তুলে দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায় ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে। সেখানেই ধর্ষণ করে চালকসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে।

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে ঘরে ঢুকে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানায়। জানা গেছে, বুধবার (১৫ জানুয়ারি) মধ্যরাতে ঘরের সিঁধ কেটে প্রবেশ করে কয়েকজন মাদকাসক্ত। এ সময় স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণ করে তারা। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে মতিয়ার, আবদুল মাজেদ, জহুরুল ও লেবু মিয়াকে গ্রেফতার করে।

অনুশোচনা নেই মজনুর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে ধর্ষক মজনু। রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মজনুকে আদালতে হাজির করে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার আবেদন জানান। মহানগর হাকিম মজনুকে যথেষ্ট সময় দেয়ার পর খাসকামরায় তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন। জবানবন্দির বিষয়টি বিস্তারিত জানা যায়নি।

সূত্রমতে, এ ঘটনায় মজনু একটুও অনুতপ্ত নয়। সে আদালতকে বলেছে, ঘটনার আগে সে ওই এলাকায় ওত পেতে ছিল। মেয়েটি বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলে সে তার পিছু নেয়। নিরিবিলি সড়কের পাশে গিয়েই সে মেয়েটিকে আক্রমণ করে। মেয়েটি এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে চিৎকার-চেঁচামেচিও করতে পারেনি। এরপর ঝোপের ভেতর নিয়ে সে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। একসময় তাকে গলাটিপে ধরে হত্যারও চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মেয়েটি অচেতন হয়ে পড়ে। মজনু মেয়েটির ব্যাগ, মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়।

মজনু আদালতকে জানায়, সে ওই এলাকায় কখনও মালামাল নিয়ে যাওয়া রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ঠেলার কাজ করে। কখনও রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে। এসব কাজ করে আয়ের টাকা সে ভিখারি বা সড়কে থাকা মেয়েদের পেছনে খরচ করত। তাদের সঙ্গে খারাপ কাজে লিপ্ত হতো। কখনও ওই স্থানে যাতায়াত করা প্রতিবন্ধী বা ভিক্ষুক নারীকে ধর্ষণ করত সে। যে স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, সেই স্থানে আরও কয়েকজনকে এভাবে সে ধর্ষণ করেছে।

৫ জানুয়ারি (রোববার) সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে শ্যাওড়ায় এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ভুল করে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নামেন তিনি। এরপর ফুটপাত ধরে শ্যাওড়ার দিকে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় তার বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা দায়ের করেন।
৮ জানুয়ারি (বুধবার) ভোরে মজনুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

পরিসংখ্যান কী বলে
গত পাঁচ বছর সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশুরাই বেশি ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে।

এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৫৮ নারী। ২০১৮ সালে শিকার হন ১৭০ জন। ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১০৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ ঘটনাগুলোকে ধর্ষণ, দল বেঁধে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা—এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার ৮১৮ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৬ জনকে এবং একই কারণে আত্মহত্যা করেন ১০ জন নারী।

দৃষ্টান্তমূলক সাজা নেই একটিও
ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৪টি। মামলা নিষ্পত্তি ৪ হাজার ২৭৭টি। সাজা হয়েছে ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়ে গেছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে আসামিরা বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে। ৫৫ শতাংশ মামলায় সাক্ষ্য শুনানির শেষে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কিছু মামলা নিষ্পত্তির কারণ নিবন্ধন খাতায় লেখা নেই, কয়েকটির নিষ্পত্তি হয়েছে আসামির মৃত্যুতে। এভাবে ৯৭ শতাংশ মামলার আসামির বিরুদ্ধেই এসব গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঁচ হাজার তিনটি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ ভাগ।

নারীপক্ষ-এর গবেষণা বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র ৪ জনের সাজা হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭২টি। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৫টি, অব্যাহতি হয়েছে ৯৮৯টি, খালাস ২৮৯টি এবং বিচারাধীন ৩ হাজার ৮৯টি। ধর্ষণের চেষ্টার মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি। অব্যাহতি ৩২৭টি, খালাস ৯৮টি এবং বিচারাধীন ৭৬১টি মামলা।

ঘরেও নিরাপদ নেই নারীরা
নারীরা এখন ঘরেও নিরাপদ নেই। এমনকি বাবাও। এসবের জন্য আসলে বিচার না হওয়াটা দায়ী। তনু হত্যার বিচার এখনও হয়নি, এমন আরও বহু উদাহরণ আছে। এখন মিডিয়ার খবরও এ ধরনের ঘটনা বাড়াচ্ছে। কারণ সহিংসতা সহিংসতাকে উসকে দেয়।

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নারী শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গ শিরোনামের একটি গবেষণা চালিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদের জেন্ডার ও উন্নয়ন গবেষক দল। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাবি প্রাঙ্গণে নারী শিক্ষার্থীরা একা চলাফেরা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইভ টিজিংসহ নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। সাধারণত ক্ষমতাশীল ছাত্রসমাজ ও নিচু শ্রেণির লোকজনের (ভিক্ষুক, পাগল, মাদকসেবী) দ্বারা ছাত্রীরা এ ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হন।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৩০ জন ছাত্রী জানান, তাদের কেউই ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়নের কারণ হিসেবে ‘পোশাক দায়ী’ তা মনে করেন না।

এসএমএম

আরও পড়ুন