• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২০, ০৮:৪৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৩, ২০২০, ০৯:৫৯ এএম

চির নিদ্রায় মেজর (অব) সিনহা, আমরা জেগে আছি কিছু প্রশ্ন নিয়ে

চির নিদ্রায় মেজর (অব) সিনহা, আমরা জেগে আছি কিছু প্রশ্ন নিয়ে

বিশেষ প্রতিবেদন
হালকা-পাতলা শরীরটা ধনুকের ছিলার মত টান টান। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ আর মাথায় খাটো করে ছাটা চুল। সাদা শার্ট আর রয়েল নেভি ব্লু প্যান্টের কলেজ ইউনিফর্ম কখনও বা বিএনসিসি কোরের খাকি গায়ে,হাঁটার তালে তালে পায়ের কালো আর্মি প্যারেড বুটের চক চকে চামড়ার ঝলসানি। কাঁধের ওপর দুই তারায় সজ্জিত লাল কলেজ ক্যাপ্টেনের রাজসিক ব্যাজ। প্রতিদিনের ক্লাস আর পড়ালেখার পাশপাশি ফুটবল মাঠ থেকে বাস্কেটবল গ্রাউন্ড সর্বত্রই ছিলো তার অদম্য বিচরণ। নিরন্তর ব্যস্ততা আর কলেজ ডিসিপ্লিনারি সম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে এক ভবন থেকে আরেক ভবন,মাঠ থেকে হোস্টেল, ক্যান্টিন থেকে ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রান্তে ছুটে চলা। সেই সঙ্গে একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের মত ছোটদের সামলে রাখা। প্রকৃতির মত বেপরোয়া-চঞ্চল কিন্তু নিয়ময়ানুসারী, প্রাণশক্তিতে ভরা ক্লান্তিহীন-দুরন্ত মানুষটাকে মনে হতো যেন 'জীবন্ত এক দু-পেয়ে ক্ষিপ্র চিতা বাঘ!'

সম্প্রতি দেশের অন্যতম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হওয়া কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে ঠিক এমনটাই দেখেছি কলেজ জীবনে। তার ব্যক্তি জীবনের অনেক ভালমন্দের কথা না জানা থাকলেও যেটুকু জেনেছি, তার বিবেচনায় বলা যায় অজানাটুকুও একেবারে মন্দ ছিল না। অন্তত বুকে গলায় পয়েন্ট ব্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিন রাউন্ড তপ্ত শিশা গেঁথে দেয়ার মত যে না,সেটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

শুধু কোনো একজন নয়, সহপাঠি ও বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা;সকলের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস সৈনিক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অন্যতম মেধাবী এবং আদর্শ একজন শিক্ষার্থী সিনাহ মো. রাশেদ সকলের মাঝে সুপরিচিত ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর স্বভাব, বন্ধুবৎসল আচরণ আর নিয়মানুবর্তীতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। অপরদিকে পেশাগত জীবনের সহকর্মী ও জুনিয়র স্টাফদের (ব্যক্তিগত পরিচয়ের প্রেক্ষিতে) ভাষ্য মতে, মেজর (অব.) সিনহার মত এমন প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত, কঠোর পরিশ্রমী ও চৌকস সৈনিকের পদচারণা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে খুব গতানুগতিক বিষয় নয়। তাদের এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করে সিনহা মো. রাশেদের পেশাগত জীবন।

৫০তম বিএমএ লং কোর্সের একজন কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যেই অল্প সংখ্যক ক্যাডেট নিজেদের যোগ্যতার বিশেষ মাত্রা প্রমাণ সাপেক্ষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স)-এর সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন,তাদেরই একজন ছিলেন প্রেসিডেন্সশীপ সোর্ড প্রাপ্ত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। কঠোর বিধি-নিষেধে ঘেরা এই সৈনিকের ব্যক্তি স্বাধীনতার অমোঘ আকর্ষণ আর পৃথিবীটা ঘুরে দেখার অদম্য ইচ্ছা যখন বার বার তার কাজের মনোসংযোগ বিঘ্নিত করছিলো,তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এমন জৌলুসের পেশাজীবন থেকে সরে দাঁড়ানোর। তিনি একজন দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তাই তাঁর জানাছিল,যে গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি কর্তব্যরত সেখানে মুহূর্তের অমনোযোগীতায় ঘটতে পারে এমন কিছু যার জন্য নিজেকে হয়তো কখনই ক্ষমা করতে পারতেন না তিনি। তার ডানপিটে স্বাধীনচেতা মনের পাগলাটে খেয়ালিপনায় যেন কোনোদিন এই বিশেষ ক্ষেত্রে বিপত্তি না আসা, সেই জন্যেই ২০১৮ সালে মূলত তিনি বেছে নেন অবসরের পথ। একজন প্রকৃত পেশাদার মানুষের পক্ষেই এই সততা প্রদর্শন করা সম্ভব বলে মনে করি। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রশ্নে তিনি নিজের সঙ্গেও আপোষ করেননি।

এবার ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে সিনহা মো. রাশেদ নামের এই সাবেক সেনা সদস্যের নিহত হওয়া ও এর পরবর্তী ঘটনাক্রম প্রসঙ্গে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। সাম্প্রতিক এই প্রসঙ্গে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে এই ঘটনার বর্ণনাত্মক দিকটি সম্পর্কে জানা গেলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান আবশ্যক বলে বোধ হয়। এ প্রশ্নগুলো কোন পক্ষকে দোষীসাব্যস্তকরণ বা দায়ি বলে শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং অস্পষ্টতা দূর করে যেটুকু জানা গেছে তার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেয়াই মূল লক্ষ্য। ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রভাবক নয় বরং সহায়ক হিসেবে প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত আনুমানিক ৯টা নাগাদ কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলাস্থ বাহারছড়া মেরিন ড্রাইভে অবস্থিত পুলিশ চেকপোস্টে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে সাবেক সেনা সদস্য সিনহা মো. রাশেদ নিহতের ঘটনা ঘটে। পু‌লিশ জানায়,সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গা‌ড়ি‌তে ক‌রে অপর একজন স‌ঙ্গীসহ টেকনাফ থে‌কে কক্সবাজার আস‌ছি‌লেন। ‌মে‌রিন ড্রাইভ সড়‌কের বাহারছড়া চেক‌পো‌স্টে পু‌লিশ গা‌ড়ি‌টি থা‌মি‌য়ে তল্লাশি কর‌তে চাইলে তিনি তার পরিচয় প্রদান করেন এবং তল্লাশি কাজে বাধা দেন। এই নি‌য়ে তর্কবিত‌র্কের এক পর্যা‌য়ে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা তার সঙ্গে থাকা পিস্তল বের করে পুলিশকে লক্ষ্য করে 'গুলি করার চেষ্টা চালালে' বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই লিয়াকত 'আত্মরক্ষার্থে' গু‌লি চালায়। এতে ওই সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। পরে‌ কক্সবাজার সদর হাসপাতা‌লে নি‌লে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা ক‌রেন। পরদিন শ‌নিবার সকা‌লে নিহ‌তের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। রিপোর্ট অনুসারে জানা যায়, নিহত সিনহার বুকে ও গলায় তিন রাউন্ড গুলি করা হয়েছে।

কক্সবাজা‌র পু‌লিশ সুপার এবিএম মাসুদ হো‌সেন এ ঘটনা সম্পর্কে জা‌নি‌য়ে‌ছেন, সামলাপু‌রের লোকজন ওই গা‌ড়ির আরোহী‌দের ডাকাত সন্দেহ ক‌রে পু‌লিশকে খবর দেয়। এই সম‌য়ে পু‌লিশ চেক‌পো‌স্টে গা‌ড়ি‌টি থামা‌নোর চেষ্টা ক‌রে। এ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে গা‌ড়ির আরোহী‌দের 'একজন' তার পিস্তল বের ক‌রে পু‌লিশ‌কে গু‌লি করার চেষ্টা ক‌রে। আত্মরক্ষা‌র্থে পু‌লিশ গু‌লি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়। পরবর্তীতে তাঁর সাবেক সেনা সদস্য পরিচয়ের কথা জানা যায়।

দুটি ভিন্ন পর্যায় থেকে পাওয়া পুলিশি বিবৃতির এই অংশটুকু খেয়াল করলে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা নিহতের ব্যাপারে পরিচয় প্রদানের পরে তল্লাশি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগের কথা জানালেও অন্য পর্যায় থেকে বলা হয়, ঘটনার পর নিহত ব্যক্তি যে একজন সাবেক সেনা সদস্য তা জানা গেছে!  তাছাড়া ঘটনাস্থল থেকে 'গুরুতর আহত' মেজর (অব.) সিনহাকে হাসপাতালে আনা হয় নাকি ঘটনাস্থলেই '...আত্মরক্ষা‌র্থে পু‌লিশ গু‌লি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়'? বিবৃতির এক্ষেত্রেও সামান্য দ্বিধা রয়েই যায়।

বিশেষ প্রতিনিধির সরেজমিন অনুসন্ধানের তথ্য মতে, মেরিন ড্রাইভের সেই সড়কে অবস্থিত পুলিশ চেকপোস্টের আগে একটি বিজিবি চেকপোস্টও রয়েছে এবং সেদিন নিহত মেজর (অব.) সিনহা সেই বিজিবি চেকপোস্ট পার হয়েই সামনে এগিয়েছিলেন। তাদের ব্যাপারে স্থানীয়দের ডাকাত সন্দেহে পুলিশের কাছে যে অভিযোগ করা হয়েছিলো বলে দাবি করা হচ্ছে,সর্বোচ্চ সতর্কতার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পুলিশ সেক্ষেত্রে কেন বিজিবি গার্ডপোস্টে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করেনি এবং সাহায্য চায়নি, সেখানেও থাকে প্রশ্ন। পরবর্তীতে আবার সাম্প্রতিক সময়ের 'জঙ্গি' ইস্যু তুলে বলা হয়েছে পুলিশ অতিমাত্রায় সতর্ক ছিল। সন্দেহজনক আচরণের প্রেক্ষিতেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে। হলি আর্টিসানের প্রত্যক্ষ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় সম্পৃক্ত আইএস সদস্যদের আর সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় বাংলা ভাইয়ের মত ভয়াবহ জঙ্গিদেরও বাংলাদেশে গ্রেফতারের পর আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, সেক্ষেত্রে দুইজন সন্দেহভাজন জঙ্গির আতঙ্কে দিশেহারা আধা প্লাটুন পুলিশ সদস্য! শুধু সন্দেহের বশেই তাই পরিচয় যাচাইয়ের ধার না ধেরে সোজা গুলি করে দেয়া! তাও একজন সাবেক সেনা সদস্যকে, যে কিনা নিজের পরিচয়ও অবগত করেছে? তাহলে সেই একই পরিচয়ের কদর করে বিজিবি কেন ছেড়ে দিয়েছিল? এই উদ্ভট ‘জঙ্গিভীতির’ তত্ত্ব কতটা যৌক্তিক তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনুধাবন অসম্ভব। এমন দুর্গম এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশই বা কেন এমন আতঙ্কে থাকবে, তাদের ব্যাক আপ কি নেই? সেটাও প্রশ্ন থাকে।

এবারে অস্ত্র তাক,গুলির চেষ্টা ও গুলির প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষেত্রে একটি বিষয় সম্পর্কে আগে জেনে নেয়া ভাল। এসএসএফ-এর এলিট ফোর্সে কর্তব্যরত সদস্যদের সক্ষমতা আর সামর্থ্য গড়পড়তা পর্যায়ের নয়। একজন ব্যক্তির নড়াচড়ার ভঙ্গি দেখেই তারা অনুমান করে নিতে পারেন সেই ব্যক্তির উদ্দেশ্য। তাদের ক্ষুরধার ইন্দ্রিয় আর বাজের মত শ্যোন দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। শত্রুর হামলা প্রতিরোধ ও পাল্টা হামলা চালানোর ক্ষেত্রে চিতার মত ক্ষিপ্রতা। খুব বিশেষ ধাঁচের বলেই তারা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয়ের নির্ভরশীল ও আস্থাভাজন অভেদ্য বর্ম বলে বিবেচিত। একজন এসএসএফ সদস্য টপ গ্রেডেড কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত। খালি হাতেই তারা একাধিক সশস্ত্র হামলাকারীকে শরীরের খুব কাছে থেকে ক্রমাগত অবস্থান পরিবর্তনের মাঝেই আঘাতে ধরাশায়ী করার ক্ষমতা রাখেন, আক্রমণের এই ফ্যান্টম ট্যাকটিক শুধুমাত্র এমন বিশেষ সেনাদেরই প্রশিক্ষন দেয়া হয়। আর অস্ত্রবাজির ইস্যুতে  সময়ের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে 'কম্বেট মার্কসম্যান' খ্যাত এই বাহিনীর সদস্যদের সমকক্ষতা অর্জন অনেক পেশাদার সৈনিকের পক্ষেও রীতিমত অসম্ভব। নূন্যতম সময়ে অস্ত্রের চেম্বার লোডিং ও নিখুঁত নিশানায় লক্ষ্যভেদ করতে পারার সব্যসাচী সক্ষমতা এই পেশার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। আর মেজর (অব.) সিনহা ছিলেন ব্যাচের অন্যতম সেরা একজন এসএসএফ এজেন্ট।

এবার দেখা যাক, কথিত সেই অস্ত্র তাকের বিষয়টি। তল্লাশিকালীন গাড়ি থেকে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান নিশ্চয় খুব দূরে ছিল না। মেজর (অব.) সিনহা তল্লাশি কাজে বাধা প্রদানের লক্ষ্যে যে কথিত 'অস্ত্র বের করে গুলি চালানোর চেষ্টা করলে' 'আত্মরক্ষার্থে' ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা গুলি চালান বলে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে নিশ্চয় নিজেকে বাঁচাতে নূন্যতম সময়ে তিনি তার অস্ত্র বের করে গুলি করার কাজটি করেছেন? অর্থাৎ অস্ত্র তাক করে থাকা একজন প্রশিক্ষিত সাবেক এসএসএফ সদস্যের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার্থে নিজের অস্ত্র বের করে তাকে গুলি করে ধরাশয়ী করার জন্য যে অতিমানবীয় ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন- বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তা সেই পুলিশ সদস্য কি করে আয়ত্ত করলেন সেটা বেশ ভাববার মত বিষয়ই বটে। কারণ, প্রশাসনিক পর্যায়ে কর্তব্যরত অভিজ্ঞ কর্তাব্যক্তিদের কাছে এই ইস্যুটি হয়তো- আসলে কোন হাতে ধরা অস্ত্রের মুখে সেদিন কার জীবন বিপন্ন ছিল সে ব্যাপারে দ্বিধা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্চয় গুলির প্রসঙ্গে আত্মরক্ষার মিথ্যে কাহিনী বলা হয়নি? আর আমরা সেটা প্রত্যাশাও করি না। প্রাসঙ্গিকভাবেই এই বিষয়গুলোতে সাবলীল সমর্থন প্রদানকারী হিসেবে চলমান তদন্ত কাজে উক্ত এসপি মহোদয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিভিন্ন মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এদিকে সামরিক বিভাগের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য ও সেনাসদর পর্যায় থেকে প্রকাশিত বিবৃতির তথ্য বলছে, ঘটনার পর একজন সেনা সার্জেন্ট সেখানে ছুটে যান। তিনি গুলিবিদ্ধ মেজর (অব.) সিনার ভিডিও ও স্থির চিত্র গ্রহনের চেষ্টা করলে পুলিশ তার মোবাইল ও পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। কিন্তু কেন? যেহেতু সেই ঘটনা একজন সাবেক সেনা সদস্য সম্পৃক্ত, সেনাবাহিনীর ফিল্ড স্টাফ হিসেবে একজন সার্জেন্ট সে তথ্য নিতেই পারেন। কিন্তু তার সঙ্গে এই ধৃষ্ট আচরণ কেন?

এছাড়া স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে জানা গেছে, গুলিবর্ষণের অন্তত পৌনে দুই ঘণ্টা পর সাবেক মেজর সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত নয়টায় গুলির ঘটনা ঘটে, ৯টা ৪৫ মিনিটে পুলিশ একটি মিনি পিকআপ আনে। এরও প্রায় পনেরো মিনিট পর হাসপাতালের দিকে রওনা হ্য় পিকআপ ভ্যান। ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর পৌঁছালে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই অপ্রত্যাশিত বিলম্বের যৌক্তিকতা কি? আর এ বিষয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেই মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন ও স্থানীয় এক ফেরিওয়ালার দেয়া তথ্য একেবারেই মিলে যায়। এই ঘটনায় তাঁরা এতটাই মর্মাহত হন যে, ভয়ডর ভুলে গিয়ে ঘটনার ব্যাপারে যে কোনো পর্যায়ে সাক্ষী দিতেও রাজি আছেন বলে জানান। অথচ গুলির ঘটনার প্রকৃত বিষয় ও হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ সিনহাকে দেরিতে নেয়ার ব্যাপারে যে প্রশ্ন উঠেছে তা জানতে জেলা পুলিশ সুপারকে ফোন করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন। অথচ জুনিয়র স্টাফের কীর্তি সমর্থনে তিনি কিনা কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই 'সিনহার হাতে অস্ত্র' তত্ত্বের সমর্থন দিয়েছেন! তবে বিশেষ সূত্র এক্ষেত্রে নিরব থাকলেও জানা গেছে যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা নিরস্ত্র মেজর (অব.) সিনহার বুকে এসআই লিয়াকতের গুলি চালানোর ঘটনা সবিস্তারে অবগত করেছে সেনাবাহিনীর অনুসন্ধানি দলকে।

এক্ষেত্রে একটি বিশেষ তথ্য উল্লেখ করা জরুরি। সংশ্লিষ্ট ফাঁড়ির একটি সূত্র জানিয়েছে, গুলির ঘটনার কিছু আগে স্থানীয় একটি থানার জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ হয় নিরাপত্তা চৌকির ইনচার্জের। এর কিছু সময় পরেই সিনহার গাড়িটি সেখানে উপস্থিত হয়। লিয়াকতের মত সেই পুলিশ সদস্যেরও বিতর্কিত অতীত ইতিহাস রয়েছে। তবে এই তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে এখনও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে কক্সবাজার প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি জানিয়েছেন, আগে থেকেই বিভাগীয় অভিযোগে গুলি বর্ষণকারী বাহারছড়া চেকপোস্টের অফিসার ইনচার্জ লিয়াকতের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় তদন্ত চলমান রয়েছে। যা নিরব অনেক প্রশ্নের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে।

নিহত মেজর (অব.) সিনহা ও তাঁর গাড়ি থেকে ইয়াবা,গাঁজা, মদ এত কিছু পাওয়া গেলেও একটা বিষয় খুবই অদ্ভুত মনে হচ্ছে। মোবাইল ফোন। হ্যা, একালে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল যার কাছে একটি মোবাইল ফোন নেই। অথচ সিনহা বা তার সঙ্গের কারোও কাছে একটা মোবাইল ছিল না সেটা খুব অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। জব্দকৃত মালামালের মাঝে এত কিছুর ফিরিস্তি উল্লেখ থাকলেও কোনো মোবাইল তল্লাশিকৃত গাড়ি থেকে বা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বলে তথ্য উল্লেখিত নেই।

পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো.রাশেদ খান নিহতের ঘটনা তদন্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৪ সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। যেখানে বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের প্রেক্ষিতে এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে এবং একটি নিরপেক্ষ তদন্তের সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার অধির প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। সিনহা মো. রাশেদ খান আর ফিরবেন না। কিন্তু দেশমাতৃকার তরে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরনকে আসবে বীর সেনানিরা। তবে যদি ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় সিনহার ন্যায় বিচার প্রত্যাশি বিদেহি আত্মা, সেক্ষেত্রে রুদ্ধ হবে আগামীর প্রাপ্তির পথ। তাই সেই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বুঝেনিতে আমাদের জেগে থাকতে হবে। আর এই জেগে থাকা বিফলে যাবে না সে কথা নিশ্চিত বলেই বিশ্বাস করি। কারণ, বর্তমানে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা মানুষটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের সরকার প্রধান নন। আপন হারানোর সর্বোচ্চ বেদনা বুকে বয়ে চলা এ জাতির এক মমতাময়ী জাগ্রত কাণ্ডারি তিনি। আজ আমরাও তাঁর মত আপন হারানোর ব্যথায় ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সেই মমতাময়ীর পানে নিরব প্রত্যাশার আকুতি নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। আপনি আমাদের অভিভাবক। আপনি আসুন, দেখুন , বিচার করুন।

অনেকেই হয়তো বলবেন এমন কত প্রাণই তো ঝরে গেল, মানুষ ভুলেও গেল। এক্ষেত্রে এত মাতামাতি কেন? কারণ আছে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বিভাগে দায়িত্বপালনকারী সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তা নিহতের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এক্ষেত্রে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্যের গুলিতে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সামরিক বাহিনীর একজন সদস্যের মৃত্যু বিশেষ এই দুইটি সংস্থার মাঝে  সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি করলে তা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিব্রতকর, দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদজনক। তাঁর চেয়ে বড় কথা, এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সমন্বিত করে বিভ্রান্তিকর বিকৃত মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের মাধ্যমেই এক সময় এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী অপশক্তি গড়ে তুলেছিল ইতিহাসের ভয়ংকরতম ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। প্রতিটি আগস্ট মাসে সেই বিভীষিকাময় কালরাত্রির ভয়াল আতঙ্ক গ্রাস করে বাঙালিকে। আজো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আবারো এসেছে রক্তাক্ত সেই কালরাত্রির মাস। যার প্রতিটি রাতের অন্ধকারেই যেন ষড়যন্ত্রের জালে বাংলার সার্বভৌমত্ব বিপন্নকারী জাতশত্রুর পদধ্বনি শোনা যায়। আর তাই বিতর্ক বা বিভেদের নূন্যতম সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে এমন সামান্য কোনো কিছুও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বাঙালি একবার সেই অসচেতনতায় অভিশপ্ত হয়েছে। আর কোনো রক্তাক্ত দুঃস্মৃতিধারী কলঙ্কিত ইতিহাসের গল্পে আমরা ঈডিপাশ হতে চাই না।

লেখক:
সহ-সম্পাদক ও সম্পাদনা সহকারী (সম্পাদক সমীপে)
দৈনিক জাগরণ।

আরও পড়ুন