• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০১৯, ০৯:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৮, ২০১৯, ০৩:৪১ এএম

টালমাটাল পুঁজিবাজার, আস্থা সঙ্কটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা  

টালমাটাল পুঁজিবাজার, আস্থা সঙ্কটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা  

ঘোষিত হচ্ছে রাইট শেয়ার, শেয়ার বিক্রি করছেন কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালকেরা, শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এছাড়া অতিরিক্ত শেয়ারের কারণে কমছে শেয়ারের দাম। আর এসব কারণে বাজারে তৈরি হচ্ছে বিক্রয় চাপ। ফলে দিনের পর দিন নানা সহায়তা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারের এই নাজুক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। গত তিন মাসেরও কম সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক কমেছে ৬৯১ পয়েন্ট। এই টানা দরপতনে একের পর এক পুঁজি হারিয়ে আস্থা সঙ্কটে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। 

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, টানা উত্থানে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ডিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে স্থিতি পায়। আর বুধবার (১৭ এপ্রিল) দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ২৫৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। অর্থাৎ গত ২ মাস ২৪ দিনে ডিএসইর সূচক কমেছে ৬৯১ পয়েন্ট। 

গত ২৪ জানুয়ারি লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। আর বুধবার দিন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ২ লাখ ৮ হাজার ১০২ কোটি টাকা। 

পুঁজিবাজারের সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, পুঁজিবাজারের এই অবস্থার জন্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর প্রথমটি হলো- বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়া। এর মূলে রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির কিছু ঝামেলা, যার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রভাব পড়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারের অন্যতম খাত ব্যাংকের অবস্থা ভালো নেই। এর অন্যতম উদাহরণ হলো বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। অনেকে মনে করছেন দেশের ব্যবসায়িক কন্ডিশন ভালো না। যার কারণে কোম্পানিগুলো ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। তবে বিনিয়োগকারীদের আমি বলব- বুঝে, জেনে-শুনে বাজারে বিনিয়োগ করবেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের দর পতনের নেপথ্যে রয়েছে কারসাজি চক্র। এছাড়া বাজারে অনিয়মকারীদের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আস্থা সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। তারল্য সংকটের কারণে বাজারে ফিরছে না বিনিয়োগকারীরা। ভুগছেন আস্থার সঙ্কটে। আর যাদের বিনিয়োগ রয়েছে তাদের লোকসানের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে। এসব কারণেই মূলত বাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। আর সর্বনিম্ন দরের শেয়ারেও বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়াও মানসম্মত আইপিও না আসার পাশাপাশি বিভিন্ন গুজবের কারণে বাজারের বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। যার কারণে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হয় পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদের সঙ্গে। তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তিন দিকে অতিরিক্ত পরিমাণে শেয়ার বেড়ে বাজার অবমূল্যায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- বেশকিছু কোম্পানি বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। আর রাইট শেয়ারের মাধ্যমে শেয়ার সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে। এসব কারণে পুঁজিবাজারে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। 

তিনি বলেন, উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কতটা সময়ের মধ্যে বিক্রি করা যাবে সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আবারো ভাবতে হবে। এছাড়া যেসব কোম্পানির শেয়ার দর ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে তাদের বাইব্যাক করতে হবে। অতিরিক্ত বিক্রয় চাপের কারণে বাজারের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৬৮ কোম্পানির শেয়ার দর বর্তমানে ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা বাইব্যাক আইন করার দাবি তুলেছেন। ইস্যু মূল্যের নিচে থাকা কোম্পানিগুলো হলো- ইউনাইটেড এয়ার, সিএনএ টেক্সটাইল, তুংহাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, ফ্যামিলি টেক্স বিডি, আইসিবি ইসলামি ব্যাংক, ঢাকা ডাইং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, আইসিবি থার্ড এনআরবি, বিডি সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, তাল্লু স্পিনিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, বেক্সিমকো সিনথেটিকস, অ্যাপলো ইস্পাত, মেট্রো স্পিনিং, জাহিন টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফিড মিলস লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জাহিন স্পিনিং, আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং, ন্যাশনাল ব্যাংক, রিয়েলায়েন্স ওয়ান, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, জিবিবি পাওয়ার, গোল্ডেন সন, খান বার্দাস পিপি ওভেন ব্যাগ, পিপলস লিজিং ফাইন্যান্স, কেয়া কসমেটিকস, আরএন স্পিনিং, ডেল্টা স্পিনিং ও ম্যাকসন স্পিনিং।

ইস্যু মূল্যের নিচে থাকা মিউচুয়্যাল ফান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইবিএল এনআরবি মিউচুয়্যাল ফান্ড, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড, ফার্স্ট জনতা মিউচুয়্যাল ফান্ড, এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, ট্রার্স্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, পিএইচপি মিউচুয়্যাল ফান্ড ওয়ান, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, আইসিবি এমসিএল সেকেন্ড মি.ফান্ড, ডিবিএইচ ফার্স্ট মি. ফান্ড, প্রাইম ফাইন্যান্স ফাস্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, এশিয়ান টাইগার সন্ধানী লাইফ গ্রোথ ফান্ড, আইসি সেকেন্ড এনআরবি ফান্ড।
 
এছাড়া আরো মিউচুয়্যাল ফান্ডের মধ্যে রয়েছে, ফনিক্স ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, আইসিবি এম্পলয়ি প্রভিডেন্ড মি. ফান্ড-১ স্কিম-১, প্রাইম ব্যাংক ফার্স্ট আইসিবি এএমসিএল মিউচুয়্যাল ফান্ড, ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, এসইএমএল আইবিবিএল শরীয়াহ্ ফান্ড, সিএপিএম বিডিবিএল মি. ফান্ড, এসইএমএল এলইসি মিউচুয়্যাল ফান্ড, আইএফআইএল আইএসএল মিউচুয়্যাল ওয়ান, আইসিবি অগ্রনী মিউচুয়্যাল ফান্ড, বিএএমএল বিডি মিউচুয়্যাল ফান্ড ওয়ান, আইসিবি সোনালী ওয়ান, ভিএএমএল আরবিবি ফান্ড, এসিসিবিএল মি. ফান্ড ওয়ান, সিএপিএম আইবিবিএল মি. ফান্ড, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল মিউচুয়্যাল ফান্ড ওয়ান, গ্রীন ডেল্টা মিউচুয়্যাল ফান্ড, এআইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড।

সূত্র আরো জানায়, গত কয়েকদিনে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে ইন্স্যুরেন্স খাতের কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার দর। এছাড়া শেয়ার দর কমেছে বিডি অটোকার, তুং-হাই নিটিং, মেঘনা পেট, হাক্কানি পাল্প, ন্যাশনাল ফিড, এমারেল্ড অয়েল ও এসএস স্টিল, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, আইএফআইসি, জুট স্পিনার্স কোম্পানির। 

পুঁজিবাজারের টানা পতনে ৬ দফা দাবিতে মানববন্ধন করে যাচ্ছে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। সংগঠনটি বলছে, যেসব কোম্পানির শেয়ার দর ইস্যু মূল্যের নিচে- তাদের বাইব্যাক করতে হবে। আইপিও বাণিজ্য বন্ধ করার পাশাপাশি তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী দৈনিক জাগরণকে বলেন, প্রথম কথা হলো পুঁজিবাজারকে ভালো অবস্থানে আনতে হলে আইপিও বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। যেসব কোম্পানির শেয়ারদর ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে তাদের বাইব্যাক করতে হবে। টানা পতন ঠেকাতে ব্যর্থ বিএসইসির চেয়ারম্যানকে পদত্যাগ করতে হবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন তিনি।

এআই/ এফসি