• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০১৯, ০৯:৫৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২২, ২০১৯, ০৪:১৮ পিএম

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ফের সিন্ডিকেট! 

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ফের সিন্ডিকেট! 

..........................................................

● নতুন আভরণে তৎপর পুরনো সিন্ডিকেটের একটি বড় অংশ 

● কর্মী পাঠাতে বিডার অনুমোদন নিয়েছে চক্রটি 

● দুই দেশের অনুমোদন ছাড়াই ১৬টি মেডিকেল সেন্টার নির্ধারণ

● এর আগেও ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আমিন নূর চক্র

● সৌদি শ্রম বাজার বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে সিন্ডিকেটটি

● সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা

..........................................................

কিছুতেই সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারছে না মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আর এই সিন্ডিকেটের দুর্নীতির কারণে মাহাথির মোহাম্মদের নতুন সরকার গত বছর মালয়েশিয়ান তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘সিনারফ্লাক্স’ এর এসপিপিএ সিস্টেমকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। জের হিসেবে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জোর প্রচেষ্টায় বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্তের সব প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন প্রায়, ঠিক তখনই নতুন আভরণে তৎপর হয়ে উঠেছে সেই পুরনো সিন্ডিকেটের প্রথমসারির নেতারা। নতুন এই সিন্ডিকেটের চালকের আসনে যথারীতি রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মালয়েশিয়ান নাগরিক আমিন নূর ওরফে আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। এরই মধ্যে জুটিয়ে নিয়েছেন ‘দাতোশ্রী’ উপাধিও। আমিন নূরের প্রধান সহযোগী হিসেবে রয়েছেন পুরনো সিন্ডিকেটের মূল হোতা জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন।

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এরই মধ্যে  ‘বেস্টিনেট বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) অনুমোদন নিয়ে রেখেছে তারা। যেখানে কোম্পানি চেয়ারম্যান হিসেবে আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর ও মোহাম্মদ রুহুল আমিনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমিনুলের নামে ১০ হাজার ও রুহুলের ২ হাজার শেয়ার দেখানো হয়েছে।

দৈনিক জাগরণ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন এই চক্রটি তাদের ঘরানার ১৬টি মেডিকেল সেন্টার নির্বাচিত করেছে। তথ্য উপাত্ত বলছে, জি টু জি প্লাস পদ্ধতি যখন বহাল ছিল তখন মালয়েশিয়ার জন্য ২৬টি অনুমোদিত থাকলেও তা এখন ১৬টিতে নেমে এসেছে। যার দুইটির মালিক নতুন সিন্ডিকেটের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান নেতা রুহুল আমিন স্বপন। ওই ১৬টি মেডিকেল সেন্টারকে মালয়েশিয়া বা বাংলাদেশ সরকার কেউই অনুমোদন দেয়নি। এ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করা হয় রূহুল আমিন স্বপনের মোবাইল ফোন নম্বরে। সরাসরি যোগাযোগ করা হয় রাজধানীর বনানীর তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসীজ ইন্টারন্যাশনালেও। সেখানে স্বপনের নাগাল মেলেনি। সেখানকার কর্তব্যরতরা জানান, তিনি (রূহুল আমিন স্বপন) দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। 

মালয়েশিয়ান গণমাধ্যম ‘দি স্টার’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাব থাকার সুবাদে ২০১৬ সালে সিন্ডিকেটের মূল হোতা আমিন নূর দুই দেশের সরকারের মধ্যকার সমঝোতা স্বাক্ষরের ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে তার বাংলাদেশ সহযোগী স্বপনের মাধ্যমে দেশটিতে যাওয়া পৌনে দুই লাখ কর্মীর সিংগভাগই তারা পাঠান। ১০ লাখ কর্মীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মীর মেডিকেল সম্পন্ন করেন তারা। এর মাধ্যমে সিন্ডিকেটের বাংলাদেশ প্রধান কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন, যার একটি বড় অংশ অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় আমিন নূরের কাছে পাচার করা হয়েছে।

মালয়েশিয়ান গণমাধ্যমে তথ্যপ্রকাশ, আমিন নূর অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছেন। তার সহযোগী ও ব্যবসায়িক সঙ্গীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।

বাংলাদেশের অন্যতম এই শ্রমবাজার সিন্ডিকেটমুক্ত করতে জি টু জি প্লাসের সিস্টেম বাতিল করে মাহাথির সরকার। ফলশ্রুতিতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়ান কোম্পানি বেস্টিনেট ও সিনারফ্লাক্স এর সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করে মালয়েশিয়ান সরকার। আমিন নূর ওই দুটি কোম্পানিরই মালিক। তাদের ডিজিটাল দুর্নীতির কারণে তিন দেশে (নেপাল, মালদ্বীপ ও মালয়েশিয়া) কালো তালিকাভূক্ত কোম্পানি এই বেস্টিনেট এসডিএন বিএইচডি ও সিনারফ্লাক্স। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবারও তারা তাদের অনলাইন পদ্ধতি কাজে লাগাতে দুই দেশে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য সিন্ডিকেট গড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া। এরই মধ্যে জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এই দুইজনের গঠিত সিন্ডিকেট থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার মুক্ত করার দাবি জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণেরও কথা বলছেন। এ ব্যাপারে তদন্তে মাঠে নেমেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

জানা গেছে, আমিন নূর ও রুহুল আমিন স্বপনের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট তাদের অনলাইন পদ্ধতি ফের বাংলাদেশে কার্যকর করতে এরই মধ্যে রাজধানীর বনানীতে অফিস খুলে বসেছে। বাংলাদেশ সরকার মেডিকেল সেন্টার নির্বাচনে মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিষ্ঠান ‘ফরেন ওয়ার্কার্স মেডিকেল এক্সামিনেশনকে (ফোমিমা) অনুমোদন ও নির্বাচনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল। আর আমিন-স্বপন গ্রুপ ফোমিমাকে পাশ কাটিয়ে ১৬টি মেডিকেল সেন্টারকে তাদের কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভূক্ত করেছেন যার দুইটির মালিক রুহুল আমিন স্বপন। 

মালেশিয়ান গণ্যমাধ্যম ‘দি স্টার’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি জনশক্তি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সিন্ডিকেট এর আগে মালয়েশিয়ার সাবেক সরকারের আমলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাছ থেকে মালয়েশিয়ায় চাকরি দেবার নামে কমপক্ষে ২০০ কোটি মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়। ওই দেশের গণমাধ্যম ‘দি স্টার’-এর অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই সময় তারা মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক সমর্থিত সরকারের মদদপুষ্ট হলেও বর্তমানে মাহাথির সরকারের নৈকট্য পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  

জানা গেছে, বিতর্কিত বাংলাদেশি মালয়েশিয়ান আমিন নূরকে অভিযুক্ত করে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় মাহাথির সরকারকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে ওই দেশে দুর্নীতির অন্যতম হোতা হিসেবে বাংলাদেশি মালয়েশিয়ান আমিন নূর ও মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছে।

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে কর্মী প্রেরণে অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আর সেটা করতে নানা উদ্যোগও দৃশ্যমান। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খোদ নিয়োগকারী দেশ মালয়েশিয়ার, সেই দুর্নীতিগ্রস্ত বেস্টিনেট ও সিনারফ্লাক্স এর মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছাকে গলাটিপে ধরা। সরকার চাইলে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে অন্যমাধ্যম প্রয়োগ করতে পারে আলোচনার মাধ্যমে।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান দৈনিক জাগরণকে জানান, ‘নানাসূত্রে জেনেছি এফডব্লিউসিএমএস এর মাধ্যমে যারা গিয়েছেন তাদের অভিবাসন ব্যয় বেড়ে গেছে। এখন আমাদের দাবি অভিবাসন ব্যয় কমানো। তার জন্য দুই দেশের সরকার একটা উপায় বের করতে পারে।’ 

তিনি বলেন, সরকার, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশেষ করে মন্ত্রী ইমরান আহমেদের জোর প্রচেষ্টায় বাজার খুলতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার ও বায়রা একযোগে কাজ করবে। কোনও সিন্ডিকেটের পক্ষে নই আমরা। সরকারও তা নিশ্চিত করতে আমাদের সব সহায়তা দেবে। 

মাহাথির সরকারের ক্ষমতায় আসার পর পরই বিদেশি কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ দেশটিতে ব্যাপক আলোচনায় আসে। অভিযোগের তীর যায় ওই দেশের দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে বাতিল করা হয় তাদের সিস্টেম ব্যবহার করে কর্মী পাঠানোর সুযোগ। আর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাই কমিশনের কতিপয় প্রভাবশালী কর্মকর্তা চাইছেন বেস্টিনেট ও সিনারফ্লাক্স এর মাধ্যমেই কর্মী যাক। এ নিয়ে তাদের লিখিত সুপারিশও রয়েছে বলে সূত্র জানায়। তবে হাই কমিশন কর্তারা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হন নি।

সূত্র জানায়, বেস্টিনেট ও সিনারফ্লাক্স এর কর্ণধার আমিন নূর ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি প্রক্রিয়া তাদের মন মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন। তোয়াক্কা করছেন না বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা। 

সদ্য পূর্ণমন্ত্রী হওয়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং অ্যাজেন্সিজ (বায়রা)। বৈদেশিক শ্রমবাজারে সাম্প্রতিক অবস্থা তুলে ধরে এ সময় মন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়া হয় বায়রার পক্ষ থেকে। তাতে বলা হয়, ‘‘বায়রার কিছু সদস্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, মিডিয়ার অপব্যবহার, সংবাদপত্রে ভুল তথ্য প্রকাশ করে সাধারণ সদস্য, দেশের গণমাধ্যম ও বিদেশে কাউন্টার অফিসসমূহকে ভুল তথ্য প্রকাশ করার কারণে সৌদি আরবে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পথে। যে সকল সদস্য এসব কর্মকাণ্ডের যুক্ত তারা বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তকে অবমাননা করে তথা প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনা অনুযায়ী করা বায়রার বর্তমান ইসি কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কমিটির নামে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করছেন। টাকা দিয়ে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা করছেন সিন্ডিকেটের মূল হোতা রুহুল আমিন স্বপন। তিনি গত মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটকারী ১০ জনের প্রধান হিসেবে কাজ করে শেষ পর্যন্ত অন্য ৯ জনকে উপেক্ষা করে বিবিধ সিদ্ধান্ত নিয়ে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারটি সে এক পর্যায়ে তার একক কর্তৃত্বে পরিচালনা করেন এবং সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিজে ভাগ করেন। বর্তমান সৌদি শ্রম বাজারটি বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এই সিন্ডিকেট। সে সঙ্গে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে পুনরায় সিন্ডিকেট করতে চাইছে তারা।বর্তমান বায়রা ইসি কমিটি সিন্ডিকেট সমর্থন করেন না। তাই আজ তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, এখন তাদের একটাই লক্ষ্য বায়রা ইসি কমিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সদস্যদের ভুল তথ্য দিয়ে চলমান শ্রমবাজার বন্ধ করে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।

এমএএম/এসএমএম 

আরও পড়ুন