• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০১৯, ০৭:২৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৩, ২০১৯, ০৭:৩১ পিএম

পানির দরে চামড়া বিক্রি

কাঁচা চামড়া রপ্তানি উন্মুক্ত করা হোক

কাঁচা চামড়া রপ্তানি উন্মুক্ত করা হোক
গোলাম মোস্তফা

গরিব-দুঃখী মানুষের হক চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তিন দশকের মধ্যে এ বছর কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়ার দাম সবচেয়ে কম। চামড়ার দাম একেবারে নেই বললেই চলে। সারাদিন অপেক্ষার পরও কোনো ক্রেতা মেলেনি। এ অবস্থায় পশুর মূল্যবান চামড়া মাটিতে পুতে ফেলেছেন অনেক কোরবানিদাতা। ঢাকাসহ সারাদেশেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশ। গত সোমবার ঈদুল আজহার দিন এবং পরদিন মঙ্গলবার এ ধরনের ঘটনা সারাদেশেই ঘটেছে। যারা কোরবানি দিয়েছেন তারা যেমন চামড়ার দাম পাননি, তেমনি দাম পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। 

রাজধানীসহ সারাদেশের চামড়ার অস্থায়ী বাজারে দেখা গেছে, প্রতি পিস ছোট চামড়ার দাম ৩শ থেকে ৪শ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫শ থেকে ৬শ এবং বড় আকারের ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দাম গত বছরের তুলনায় অর্ধেক। চামড়ার দাম কমায় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অসহায়-নিঃস্ব সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র এবং এতিমখানা নিবাসী মাতৃৃপিতৃৃহীন শিশুরা। অন্যদিকে কারসাজি করে চামড়ার দাম কমান মুনাফাকারী-সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ট্যানারি শিল্প-মালিক থেকে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। 

তিন-চার বছর আগেও কোরবানি ঈদের সময় পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে রাজধানীর অলিগলিতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা দেখা যেত চোখে পড়ার মতো। কোথাও কোথাও তো চামড়া ক্রয় নিয়ে রীতিমতো হুমকি-ধমকি, এমনকি হানাহানির ঘটনাও ঘটত। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সেই তৎপরতা কমতে শুরু করে গত কয়েক বছর থেকে। এ বছর তাদের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় চামড়া নিয়ে বসে থাকলেও ক্রেতা মিলছে না। যারা আসছেন, তারাও চামড়ার দাম খুবই কম বলছেন। অথচ অন্যান্য বছর কোরবানির পরপরই চামড়া কিনতে ভ্যান নিয়ে হাজির হতেন পশুর মালিকের দোরগোড়ায়। দামও পাওয়া যেত ভালো।

কয়েক বছর আগেও প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৯০ টাকা। বর্তমানে তা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে ৪৫ টাকায়। অথচ কয়েক বছরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে চামড়ার তৈরি জিনিসপত্রের দামও। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ৫ হাজার কোটি টাকার এ ব্যবসা চলছে কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই। এ শিল্পের পুরোটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে। মূল্য নির্ধারণ থেকে শুরু করে রপ্তানি বাজার নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই চলছে তাদের ইশারা-ইঙ্গিতে। 

................................................

 ‘‘এক সময় দেশ থেকে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ ছিল; কিন্তু দেশীয় পাদুকা ও চামড়াজাত অন্যান্য শিল্পের বিকাশের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাঁচা চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করে কেবল ফিনিশড লেদার বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির অনুমোদন রাখা হয়। এ সুযোগে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর চামড়ার দামে কারসাজি করে আসছে। এক্ষেত্রে ট্যানারি শিল্প অন্যান্য শিল্পের মতো প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে সীমিত কিছু ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে।’’

................................................

বিভিন্ন অজুহাতে মূল্য কমানোর পরও দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দামও পায়নি কোরবানিদাতা, খুদে ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এটি জাতীয় সম্পদ, কিন্তু দাম নিয়ে শেষ পর্যন্ত যা হলো তা অশোভনীয় ও অমার্জনীয়। সরকার নির্ধারিত দাম দেশের কোথাও কার্যকর হচ্ছে না। এ বাস্তবতায় কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয়াই হতে পারে সঠিক পন্থা। এতে একচেটিয়া ব্যবসার লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব হবে বলে অভিজ্ঞদের অভিমত। আগে দেশ থেকে সরাসরি কাঁচা চামড়া রপ্তানি হতো। দেশীয় শিল্প বিকাশের অজুহাতে কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ রেখেছে সরকার।

কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করার পর এখন ট্যানারি শিল্প মালিকরা দাবি করেছেন- চামড়া যেন পাচার হতে না পারে সেজন্য সীমান্তে বিজিবির নজরদারি ও টহল বাড়ানোর। প্রান্তিক জনমানুষের ক্ষতি করে কেবল কতিপয়ের স্বার্থরক্ষার জন্যই সরকারকে সবকিছু করতে দেখা যায়। আমাদের দেশে কৃষি, গার্মেন্ট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত শ্রমিক, গরিব-দুঃখী মানুষের চেয়ে মালিকদের স্বার্থ দেখার প্রবণতা অতীতে যেমন ছিল এবং এখনও আছে তেমনি। তাই চামড়ার দামে বিপর্যয় দেখে বিভিন্ন পর্যায়ে এমন প্রশ্ন উঠেছে, চামড়ার জুতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্যের দাম যখন আকাশছোঁয়া, তখন চামড়ার দাম কেন না বেড়ে বছরের পর বছর কমতে থাকে? এর পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ রয়েছে।

এক সময় দেশ থেকে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ ছিল; কিন্তু দেশীয় পাদুকা ও চামড়াজাত অন্যান্য শিল্পের বিকাশের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাঁচা চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করে কেবল ফিনিশড লেদার বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির অনুমোদন রাখা হয়। এ সুযোগে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর চামড়ার দামে কারসাজি করে আসছে। এক্ষেত্রে ট্যানারি শিল্প অন্যান্য শিল্পের মতো প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে সীমিত কিছু ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। ফল হিসেবে পাশের দেশ ভারতে যেখানে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ১১০-১২০ টাকা এবং অন্যান্য দেশে এ দাম ২৪০-২৫০ টাকা; সেখানে আমাদের দেশে তা মাত্র ৪৫-৫০ টাকা! ট্যানারি মালিকদের দাবির মুখে সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া এ দাম দিতেও তাদের অনীহা। 

এ অবস্থায় কাঁচা চামড়া রপ্তানি ফের উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি যৌক্তিক এবং অতিদ্রুত তা বিবেচনায় নেয়া দরকার। আশার কথা, জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও ট্যানারি মালিকদের একচেটিয়া বাণিজ্য ভেঙে দিতে এবং বেশি দামের আশায় পাচার বন্ধ করতে কাঁচা চামড়া রপ্তারির অনুমতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। অবিলম্বে এটি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি আমলে নেয়া যাবে না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বলে, কাঁচা চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ আগেও নেয়া হয়েছিল; তখন ট্যানারি মালিকরা দাম বাড়িয়ে এ উদ্যোগ ঠেকিয়ে দেয়। এবার যেন তেমনটি করতে না পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

................................................

 ‘‘দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত, যা বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করছে, তার উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য। ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতের আয় অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও আছে। এ বছরের বাজেটেও চামড়া ও পাদুকা শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ সুবিধা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতকিছুর পরও কিন্তু কথা থেকে যায়’’

................................................

কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেয়া হলে গরিব-দুঃখী মানুষ যেমন চামড়ার পয়সা থেকে উপকৃত হবে, তেমনি এ খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। যে কোনো খাতের নতুন উদ্যোক্তা সে খাতের জন্য আশীর্বাদ। চামড়ার মতো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি উৎসাহব্যঞ্জক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বব্যাপী ২২ হাজার কোটির বেশি ডলারের চামড়ার বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ এর মাত্র সামান্যই পূরণ করে থাকে। প্রতিবছর দেশে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে দেশের চাহিদা মেটাতে খুব কম চামড়াই লাগে। বেশির ভাগ চামড়া তাই রপ্তানি করা হয় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে।

যেহেতু ফিনিশড চামড়া রপ্তানি করা হয়, তাই ওয়েট-ব্লু লেদার বা কাঁচা চামড়া সরাসরি রপ্তানি করার সুযোগ দেয়া কোনোভাবেই অযৌক্তিক হতে পারে না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কাঁচা চামড়া রপ্তানির রেওয়াজ বিবেচনায় নিয়ে চামড়া রপ্তানি অতিদ্রুত উন্মুক্ত করে দেওয়াই হবে এ মুহূর্তে কল্যাণকর ও যুক্তিযুক্ত একটি উদ্যোগ।

চামড়া শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৭ সালে ‘ট্রেড শো লেদারটেক বাংলাদেশ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ শিল্পে বিদ্যমান কর ও নগদ অর্থায়ন সুবিধা পাঁচ বছর বহাল রাখার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সুবিধা এখনও চলমান। এর পরিপূরক হিসেবে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ থেকে সাভার ট্যানারি এস্টেটে স্থানান্তরিত হয়েছে। শিল্পনীতিতে এ খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরির বিষয়টিও সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং নীতিমালা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ সবকিছুই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত, যা বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করছে, তার উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য। ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতের আয় অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও আছে। এ বছরের বাজেটেও চামড়া ও পাদুকা শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ সুবিধা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতকিছুর পরও কিন্তু কথা থেকে যায়। খোদ কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পান না, শ্রমিক তার শ্রমের মূল্য থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন; কোরবানির কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দামের হক যাদের, তারা প্রতিবছরই প্রতারিত হচ্ছেন— বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। এদের মুখে হাসি ফোটানোই আমাদের কর্তব্য। ▪

আরও পড়ুন