• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০১৯, ০৮:৪৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২২, ২০১৯, ০৮:৪৭ এএম

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রতিবেদন

চট্টগ্রামে কন্টেইনার জালিয়াতিতে বন্দর-কাস্টমসের ৩২ কর্মকর্তা

চট্টগ্রামে কন্টেইনার জালিয়াতিতে বন্দর-কাস্টমসের ৩২ কর্মকর্তা

চট্টগ্রাম কাস্টমসে এসাইকুডা সিস্টেমসে ঢুকে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৭ কন্টেইনার জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত বন্দর ও কাস্টমস বিভাগের ৩২ কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তা বদলি হলেও এদের আইডি বন্ধ করার পাশাপাশি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া এই জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছে ৭ সিএন্ডএফ এজেন্ট ও ১৪ আমদানিকারক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করা তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। জাতীয়  রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বন্দরের বিশাল একটি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এতে জড়িত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, অসাধু আমদানি কারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গোপন আঁতাত করে যথাযথ শুল্ক আদায় না করে কন্টেইনার খালাসে সহযোগিতা করছে। চট্টগ্রাম কাস্টসমের ২২ কনসাইনমেন্টের ২৭টি কন্টেইনারে  পণ্য আনার সংবাদ পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কর্তৃক পণ্যগুলো খালাস না করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে চিঠি দেয়। পরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করার সিদ্ধান্তে পণ্যগুলো ছাড় না করার জন্য এনবিআরের সার্ভার লক (বন্ধ) করে রাখা হয়। পরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন পণ্যগুলো বন্দর থেকে খালাস হয়ে গেছে। 

সুচতুর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কিছু কাস্টমস কর্মকর্তাকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে বন্দর থেকে পণ্যগুলো খালাস করে নিয়ে যায়। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাস্টমস কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে লক থাকা বিল অব এন্ট্রির চালান অবসরে যাওয়া রাজস্ব কর্মকর্তা ডিএএম মহিবুল ইসলাম ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল হকের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লক খুলে বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্যের চালান ছাড় করে নিয়ে যায়। এই ভয়াবহ জালিয়াতি করা হয়েছ ২২টি চালানে। এর সঙ্গে জড়িত ১৫ জন রাজস্ব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয় প্রতিবেদনে। 

এ ঘটনায় জড়িত যেসব কাস্টমস কর্মকর্তারা 

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম সরোয়ার (বর্তমানে এনবিআরে কর্মরত), ডেপুটি কমিশনার শাহিনুর রহমান পাভেল, রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, শহিদুল ইসলাম, নুরে আলম, হাবিবুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, মেহেরাব আলী, এস এম মোশারফ হোসেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এ এইচ এম নজরুল ইসলাম, শাহরিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ নূর ই আলম, সাইফুন্নাহার জনি, মির্জা সাইদ হাসান ফরমান।

বন্দর বিভাগের যেসব কর্মকর্তারা-কর্মচারিরা 

উচ্চমান বহিঃসহকারী শাহাবুদ্দিন, সানোয়ার মিয়া, মফিজুর রহমান হেলেন, শেখ বাচ্চু মিয়া, ইলিয়াস, হামিদুর রহমান, নাজিম উদ্দীন, কবির আহম্মেদ, শ্যামল
কৃষ্ণ ভৌমিক, সালাউদ্দিন পায়েল, মোরশেদুল হাসান, ওমর ফারুক, অর্পণ কান্তি দেবনাথ, মাইনুদ্দীন, অনিক, আব্দুল গনি, মোস্তাফিজুর রহমান।

জালিয়াতিতে জড়িত যেসব সিএন্ডএফ ও আমদানিকারকরা

চট্টগ্রাম কাস্টমসে কাজ করা লাবনী এন্টারপ্রাইজ, চাকলাদার সার্ভিস, এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এমঅ্যান্ডকে ট্রেডিং করপোরেশন, মজুমদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, লায়লা ট্রেডিং কোম্পানি, স্মরণিকা শিপিং কাইজেন লিমিটেড। আর আমদানিকারকরা হলেন, এস এ এম ইন্টারন্যাশনাল, খান এন্টারপ্রাইজ, কাশিমপুর, গাজীপুর, এম এস সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নবাবপুর, ঢাকা, জারার এন্টারপ্রাইজ, আর কে ইন্টারন্যাশনাল, সিফাত ট্রেডিং, গুলশান, এইচ এল ট্রেডিং করপোরেশন, উত্তরা, মিমি লেদার কটেজ, হাতিরপুল, এ কিউ ট্রেডিং, মতিঝিল, এম এস জাহিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এস পি ইন্টারন্যাশনাল, চকবাজার, এস কে এস এন্টারপ্রাইজ, পাবনা, এমডি ওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল, মুভিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

প্রসঙ্গত, এ ব্যাপারে এনবিআরের বিভিন্ন দফতর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে এনবিআর তদন্ত কমিটির প্রধান কমিশনার (আপিল) ফখরুল আলম, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কমিটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাকিম, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) কমিটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস গঠিত কমিটির প্রধান যুগ্ম কমিশনার এইচ এম শরিফুল হাসান। এ ছাড়াও পুলিশের সিআইডি ঘটনার তদন্ত করছে।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এনবিআরের সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে অবৈধভাবে পণ্য খালাস করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা ঘোষণায় বৈধ পণ্য আমদানির আড়ালে অবৈধ পণ্য (অস্ত্র/বিস্ফোরক/গোলাবারুদ) দেশে প্রবেশ করাতে পারে মর্মে প্রতীয়মান। এ ছাড়াও সার্ভার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় দেশের ভাবমর্যাদাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং বন্দরের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রফতানিকৃত পণ্যের রাজস্ব আদায় ও মিথ্যা ঘোষণায় ফাঁকি রোধ করার দায়িত্ব কাস্টমস কর্মকর্তাদের। অথচ দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বড় জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও সার্ভার হ্যাক করার ঘটনা ঘটেছে মর্মে প্রতীয়মান। এতে অসাধু আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। আর ২৭টি কনটেইনারের চালানগুলো ছাড়াও বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছ থেকে কাস্টমসের ডিসি শাহিনুর রহমান পাভেল ও রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ অবৈধ অর্থের বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণ আমদানিকৃত পণ্য খালাসে সহযোগিতা করেছে। এ ঘটনায় জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ সংক্রান্ত আরো তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

প্রতিবেদনের মতে সার্ভার জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য পাচারের ঘটনায় জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং তদন্তে নিয়োজিত কাস্টমস কর্মকর্তারা একজন আরেক জনের পরিচিত। কাজেই এই তদন্ত কমিটি দিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার বিষয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এ ছাড়াও জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তথ্যানুসন্ধানে প্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাস্টমস হাউজে অদ্যাবধি কর্মরত। ফলে তদন্ত কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শাস্তির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপারিশগুলো ঘটনার বিষয়ে দ্রুত তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে, তদন্তে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রতিবেদনে উল্লিখিত ব্যক্তিদের অন্যত্র বদলির ব্যবস্থা করা, ২২টি চালান ছাড়ের ঘটনায় সম্পৃক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা, এনবিআর সার্ভারের (অ্যাসাইকুডা) সফটওয়্যারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী অবসরে গেলে কিংবা অন্যত্র বদলি হলে তাৎক্ষণিক তাদের ব্যবহৃত ইউজার আইডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা জরুরি। দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চট্টগ্রাম বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়া এবং সেই সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করা। 

এআই/বিএস 

আরও পড়ুন