• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২২, ০৮:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১২, ২০২২, ০৮:১৯ পিএম

বিদেশি বিনিয়োগে  ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

বিদেশি বিনিয়োগে  ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি সূচক নিয়ে সুখবর দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও একই সুসংবাদ এসেছে।

আঙ্কটাড বলেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়ে মহামারির আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে।

সংস্থাটির হিসাবে বিভিন্ন দেশ থেকে গত বছর দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২৮৯ কোটি ৬০ লাখ (প্রায় ২.৯ বিলিয়ন) ডলার। মহামারি শুরুর বছর ২০২০ সালে এসেছিল ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ (২.৫৬ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৯ সালে এসেছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

তবে এর আগের বছর ২০১৮ সালে রেকর্ড এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ; ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।

শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, প্রকল্পে আন্তর্জাতিক অর্থায়নেও বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। এক বছরে আন্তর্জাতিক প্রকল্পের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে ২০২১ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রকল্পের চুক্তির পরিমাণ অনেক বাড়ার খবরও দেয়া হয়েছে। গত বছর মোট ৪৭০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক ১৪টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছে, যা আগের বছরের তিনগুণ।

এর মধ্যে ২০০ কোটি ডলার ব্যয়ে চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহরের আনন্দ বাজারে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি সবচেয়ে বড়।

একই সময়ে বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের প্রবাহও আগের বছরের চেয়ে সাত গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারে, ২০২০ সালে যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআই টানার ক্ষেত্রে সেরা পাঁচে ছিল বাংলাদেশ। আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোতে ১৩ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, গত বছর বিশ্বজুড়ে এফডিআই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রাক মহামারি অবস্থায় পৌঁছেছে বিনিয়োগ, যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার।

তবে আঙ্কটাডের প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থায়ন সংকটে ত্রিমুখী চাপ তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

যদিও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই), কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক অবকাঠামো এবং কৃষিষহ প্রধান উন্নয়ন খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ, চীন, কলম্বিয়া, নাইজেরিয়া এবং তুরস্ক টেকসই ব্যাংকিংয়ের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আঙ্কটাডের টেকসই আর্থিক নীতি বিষয়ক তথ্যভাণ্ডারে সম্পৃক্ত ৩৫টি দেশের মধ্যে ছয়টি দেশ একটি ‘ট্যাক্সোনমি’ গড়ে তুলেছে বলে জানায় সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে বলা হয় ৩৫টি দেশ এবং বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জোটগুলোর টেকসই আর্থিক পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন নীতির সবশেষ উন্নয়ন পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করছে আঙ্কটাড।

এর মধ্যে সুইজারল্যান্ড এবং জি-২০ ভুক্ত ১৩টি উন্নয়নশীল দেশ এবং আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো রয়েছে। বিশ্বের মোট জিডিপিতে ৯৩ শতাংশ অবদান এসব দেশ এবং জোটের ।

উন্নয়নশীল ১৩ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ, চিলি, কলম্বিয়া, মিশর, হংকং (চীন), কেনিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভিয়েতনাম।

১০ মাসে এফডিআই বেড়েছে ৩৫.২১ শতাংশ

আঙ্কটাডের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকও এফডিআই-এর ক্ষেত্রে একই সুখবর দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে বিদেশি বিনিয়োগের সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৮৮ কোটি ২০ লাখ (৩.৮৮ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।

২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ২৮১ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ। এই ১০ মাসে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

আর মাত্র ১২ দিন! তার পরই বাংলাদেশের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত একটি স্বপ্ন পূরণ হবে; ২৫ জুন চালু হবে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন।

ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটিকে ঘিরে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চারের আশা করছেন সবাই। যার ঢেউ বিদেশি বিনিয়োগেও পড়েছে। পদ্মা সেতু ঘিরে দেশে বিনিয়োগের নতুন আবহ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে এই বিনিয়োগ আরও বাড়বে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে না। এই যে প্রচুর আমদানি হচ্ছে, ডলারের চাহিদা বেড়েছে তার মানে এখন দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে। আর এ সবকিছুই কিন্তু পদ্মা সেতুকে ঘিরে হচ্ছে।

‘যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছিল, পদ্মা সেতু তার থেকেও বেশি অবদান রাখবে অর্থনীতিতে। এ বিষয়টি দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বুঝতে পারছেন। সে কারণেই দেশি বিনিয়োগের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেড়েছিল, তবে বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এখন সবকিছু অনুকূলে থাকায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি এসেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করছেন। সে কারণেই আমদানি বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে।’

বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ফেরায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। অন্য সূচকগুলোও ভালো।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই দীর্ঘদিন। পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাচ্ছে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও এ বছরেই চালু হবে। সব মিলিয়ে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগেও একটি ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। এখন এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিলে দেশে এফডিআই আরও বাড়বে।’

সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি।’

এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে এখন যেহেতু দেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে।’