• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৯, ০৭:০৪ পিএম

অধরা স্বপ্নের প্রবাস

অধরা স্বপ্নের প্রবাস

 

প্রবাসে পাড়ি জমানোটা যেন অনেক বাঙালির কাছে স্বপ্নের মতো। অনেকের ধারণা সেখানে স্বপ্ন কিনতে পাওয়া যায়; বাতাসে যেন টাকার ছড়াছড়ি। তাই জীবিকা ও জীবনের তাগিদে, সোনালী স্বপ্নের হাতছানিতে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। তবে প্রবাস জীবনে কী স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে মেলানো যায়। চলুন এক প্রবাসীর জীবনের স্বপ্নের পথে হাঁটার গল্পটা তার কাছ থেকেই শোনা যাক
 

আমি একজন প্রবাসী। প্রবাস কথাটা শুনলেই কলিজার পাশ কাটিয়ে একটা দাগ কেটে যায়। যখন দেশে ছিলাম তখন আমার বাবা ছিলেন একজন প্রবাসী। বাবার কাছে কত চাহিদা ছিল, সব চাহিদা বাবা হাসিমুখে পূরণ করতেন।

তাই আমিও ভেবে নিয়েছিলাম প্রবাসে মনে হয় অনেক সুখ আর টাকা বাতাসে ওড়ে। তাই বাতাসের উড়ন্ত টাকা ধরতে চলে এলাম প্রবাসে; আর আমার নাম হয়ে গেল প্রবাসী। প্রবাসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গিয়েছিলাম জীবন কী জিনিস।

যেদিন এসেছিলাম তার পর দিন থেকেই কাজ শুরু করেছিলাম। ভালো প্যান্ট-শার্ট পরে যখন গাড়িতে করে কাজের স্থানে নিয়ে গিয়েছিল, তখন মনের সব স্বপ্ন চোখ দিয়ে বের হয়ে উড়ে গেল ওই নীল আকাশে- যেখানে স্বপ্ন দেখতাম চেয়ার-টেবিলে বসে অফিস করব।

এভাবেই প্রতিটা প্রবাসী একদিন তার নিজ স্বপ্নগুলোর কথা নিজের অজান্তেই ভুলে যায়। যতই দিন যায় ততই চাহিদা বাড়ে; কিন্তু বেতন বাড়ে চাহিদার ১ শতাংশ।

একটা প্রবাসীর কাঁধের ওপর ভর করে কয়েকটা জীবন স্বপ্ন সাজায় ভালো থাকার। প্রবাসী ছেলেটা হাজারো কষ্টের বিনিময়ে পরিবারের জন্য মাস শেষে টাকা পাঠায়, বসের কাছে প্রতিদিন কত কথা শুনতে হয় তা শুধু যারা প্রবাসে থাকেন তারাই জানেন।

সারা দিন কাজ করে বাসায় ফিরে কাপড় পরিস্কার করতে হয়, রান্না করতে হয়, গোসল করে বাড়িতে ফোন দিয়ে সবার খোঁজখবর নিতে হয়- তাও হাসিমুখে।

কিন্তু বাড়ি থেকে শুনতে হয় শুধু চাহিদার কথা। এই মাসে এত লাগবে, এই খরচ ওই খরচ শুধু খরচ আর খরচ। আর সেই চাহিদার বোঝা মাথায় নিয়ে যখন ছেলেটা ঘুমাতে যায়, তখন আর ঘুম আসে না চিন্তায়।

রাত শেষ হয়ে ভোর হয়। আবার কাজ শুরু সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা-১০টা। এভাবেই চলতে থাকে একজন প্রবাসীর গল্প।

আজ একজন ছেলের এক মাসের ইতিহাস লিখব এখানে। ছেলেটার নাম আব্দুল্লাহ, বাড়ি টাঙ্গাইল। চার বছর হলো সিঙ্গাপুর থাকে।

ছেলেটার মনে অনেক অভিমান, সেগুলো এখানে নাইবা বললাম। প্রতি মাসে ওর পরিবার বেতন পাওয়ার আগেই টাকার জন্য চাপ দিত।

আব্দুল্লাহ আমার সঙ্গেই থাকে। ওকে আমার অনেক ভালো লাগে। দেখতে সুন্দর, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। একসময় ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিল। সংসারের অভাবের তাড়নায় সে আজ প্রবাসী।

আমি ওর সুপারভাইজার হওয়ায় আর বড় ভাইয়ের স্নেহ দেয়ায় সে সব কিছু শেয়ার করতো আমার সঙ্গে। গত কয়েক মাস ধরে আব্দুল্লাহ মনমরা হয়ে থাকত। বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা দিয়ে দিতে হয়।

কয়েক দিন হলো আব্দুল্লাহ চুপচাপ হয়ে গেছে; কিছু জিজ্ঞেস করলেই চোখ ছলছল করে ওঠে আর বলে ভাই- সেলারি দেবে কবে?

প্রতি মাসের ৬-৭ তারিখ বেতন আসে; কিন্তু আজ ১০ তারিখ বেতন আসেনি। বাড়ি থেকে একটু পর পর ফোন দিচ্ছে টাকার জন্য।

ওর খাবার টাকাও শেষ। কাজে আসার জন্য প্রতিদিন বাস ভাড়ার টাকা তাও শেষ এক সপ্তাহ আগেই। এক সপ্তাহ আগে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি রেডি হয়ে বসে আছে, কিন্তু রুম থেকে বের হচ্ছে না।

কাছে যেতেই বলল ভাই কাজে যেতে পারব না। পরে ২০ ডলার দিয়ে কাজে যেতে বললাম।

আজকে ১০ তারিখ হয়ে গেছে কিন্তু বেতন আসেনি, টাকাও নাই। লজ্জায় বা যে কোনো কারণে আমাকেও কিছু বলেনি। একা একাই রুম থেকে চুপ করে বের হয়ে গেল।

ট্রেন স্টেশন এসে আব্দুল্লাহ আশায় আছে যদি কোনো পরিচিত কেউ আসে তার কাছ থেকে ২ ডলার নিয়ে টিকিট কেটে আসবে। কিন্তু পরিচিত কাউকে পায়নি, তাই অপরিচিত কয়েকজন বাংলাদেশি ভাইয়ের কাছে হাত পেতেও ২ ডলার পায়নি। কিন্তু সে মাস শেষে ঠিকই ৮০ হাজার টাকা বেতন পায়।

আব্দুল্লাহ তখন নিরুপায় হয়ে এক সিঙ্গাপুরিয়ান মহিলার কাছে ২ ডলার চায়। লিখতে গিয়ে আমার চোখের জল ফোনের ডিসপ্লেতে পড়ছে।

কী বলব ভাই বিশ্বাস করেন সঙ্গে সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলা ১০ ডলার দিয়ে বলল, ‘বেবি ইউ হ্যাভ ফুড মানি?’

এই কথা বলার পর আব্দুল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে কান্না শুরু করল। ভদ্রমহিলা আবারও বললেন, ‘ডোন্ট ক্রাইং মাই বেবি, প্লিজ টেল মি এনি মোর প্রবলেম?’ আব্দুল্লাহ আবেগে থ্যাংকস ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি।

এই গল্পের মধ্য দিয়ে বোঝার নিশ্চয়ই বাকি নেই প্রবাস জীবনের নিষ্ঠুরতা, নিঃসঙ্গতাকে। নিষ্ঠুর জীবনযাপন এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে দেয়ালবিহীন কারাগারে এতিমের মতো বসবাস করার নামই প্রবাস জীবন। কারও দুঃখ কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। নিজের দুঃখ নিজের অন্তরে রেখে নীরবে কান্না করতে হয়। প্রবাসে যারা এসেছেন একমাত্র তারাই প্রবাসজীবন যে কতটা নির্দয় ও নির্মম তা উপলব্ধি করতে পারেন। 

তবে সবাই যে খারাপ অবস্থায় আছেন তা কিন্তু নয়। অনেক বাংলাদেশি ভাই আছেন তারা ভাল পদে চাকরি করে বেশি বেতন পাচ্ছেন। তাদের পরিবার পরিজনেরা সুন্দরভাবে দিনাতিপাত করছেন।

তাই আমার অনুরোধ যারা বিদেশে চাকরির জন্য নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করছেন তারা যেন একটু যাচাই বাছাই করে বিদেশে পাড়ি জমান। যাতে করে প্রবাস পাড়ি স্বপ্ন পূরণের নাম হয়; সর্বনাশের কারণ না হয়ে ওঠে।