• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২০, ০১:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৮, ২০২০, ০১:৪০ পিএম

বদি দম্পতির আশীর্বাদেই জ্বলছিলো প্রদীপ!

বদি দম্পতির আশীর্বাদেই  জ্বলছিলো প্রদীপ!
বদি-প্রদীপের আলোচিত সেই ছবি- সংগৃহিত

গতানুগতিক মাদক সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নয় বরং বিশেষ কোনো কারণেই প্রদীপ-লিয়াকত সিন্ডিকেট মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তবে কি সেই বিশেষ কারণ তা এখনো রয়ে গেছে অন্ধকারে। আশা করা হচ্ছে এ ঘটনার তদন্ত কাজে নিয়োজিত দিলটি যে গতিতে কাজ করছে তাদের হাত ধরেই আলোতে আসবে সেই সত্যতা।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের একটি ছবি ভাইরাল হলে এর নেপথ্যে কি আছে তা জানার জন্য চালানো হয় অনুসন্ধান। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণে বোঝা যাচ্ছে, বদি দম্পতির আশীর্বাদপুষ্ট বলেই অপ্রতিরোধ্য এক নৃশংস 'কিলিং মেশিন' হয়ে ওঠে প্রদীপ কুমার। কক্সবাজার অঞ্চলের আলোচিত এই সাবেক এমপি ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে শনাক্ত হলেও বিস্ময়করভাবে তিনি রয়ে যান আইনের নাগালের বাইরে।

তাছাড়া 'লোক দেখানো শাস্তির প্রহসনমূলক আচরণ' হিসেবে তার পরিবর্তে তার স্ত্রীকে ক্ষমতাসীনদলের মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি ছিল অনেকের কাছেই বিব্রতকর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুম, খোদ দলটির একাধিক নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এ প্রসঙ্গে।

সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সময় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণে সামনে আসে টেকনাফের সদ্যসাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের গডফাদারের নাম। জানা গেছে, প্রদীপের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা ছিলেন কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মাদক সম্রাট আব্দুর রহমান বদি। কক্সবাজারে মাদকের বিরুদ্ধে যত অভিযান চালিয়েছে পুলিশ সেখানে বদিকে স্পর্শই করা হয়নি। চার মাস আগেও বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রদীপকে টেকনাফ থেকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। তখন এই বদলি ঠেকাতে বদির স্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এসপির কাছে ডিও লেটার দিয়েছিলেন। বদির ক্যাডার হিসেবেই প্রদীপ ছিল সবকিছুর উর্ধ্বে। একই সঙ্গে এই বদি-প্রদীপ সম্পৃক্ততায় সংশ্লিষ্টা রয়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একাধিক কর্তাব্যক্তিরও।

স্থানীয়ভাবে 'বদির ওসি' খ্যাত প্রদীপ কুমার নাম কামাতে শুরু করে অল্প দিনেই। স্থানীয়রা জানান, প্রদীপ পুলিশের ওসি ছিল না, সে ছিল বদির ওসি। একাধিকবার প্রদীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তাকে সাময়িক বরখাস্তের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু বদির তেজে তাকে কেউ কিছুই করতে পারেনি। দলের এমন বিতর্কিত একজন সাবেক এমপিকে কারাই বা এয়টা শক্তির যোগান দেন তাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

গত কয়েক বছর ধরেই বদির বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। কিন্তু তার বদলে মনোনয়ন পান তার স্ত্রী শাহীন আক্তার শাহীন আক্তার চৌধুরী। তিনি নির্বাচনে জয়ীও হন। কিন্তু কাগজে কলমেই শুধু তিনি এমপি। সমস্ত কিছু চলে বদির নির্দেশে। আর সেটাই যে হবার ছিল তা জেনেশুনেও কেন এমন কিছু করা হলো তা নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। স্থানীয়রা জানান, বদির হুকুম ছাড়া কক্সবাজারে গাছের পাতাও নড়ে না। গত ২ বছরে বদির অন্যতম ক্যাডার হয়ে ওঠেন প্রদীপ।

প্রকাশ্যে মাদকের নেটওয়ার্ক সঞ্চালনকারী হলেও মাদকের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ কেন যেন বার বারই বদির দুর্গে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে বদি কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী কোনো সত্ত্বায় পরিণত হয়েছেন!

গত ৩১ অগাস্ট রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওসি প্রদীপের নির্দেশেই এই হত্যা বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই তাকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন একের পর এক বেরিয়ে আসছে তার সমস্ত কুকীর্তি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশের যোগদানের পর থেকেই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়ক আতঙ্কের ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ জোনে পরিণত হয়। দুই বছরে এ সড়কে ক্রসফায়ারে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে।

মাদক নির্মূলের নামে ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা করা ছিল প্রদীপের নিত্যদিনের কাজ। এই উন্মাদনা থেকে বাঁচতে পারেননি মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানও। তবে সিনহা যে গতানুগতিক মাদক ইস্যুতে প্রাণ দেননি সে ব্যাপারে অনেকেই ভ্রু নাড়ছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২২ মাসে প্রদীপের নির্দেশে টেকনাফে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২০৪ জন মারা গেছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। যাকে ক্রসফায়ার করা হতো তাকে ১০ থেকে ১২ দিন থানা হাজতে রাখা হতো। আবার মাসের পর মাস থানা হাজতে রাখার ঘটনাও রয়েছে। এ সময় ক্রসফায়ারে না দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে নিত প্রদীপ। তবে শেষ সম্বলটুকু দিয়েও বাঁচতে পারেনি অনেকেই।