• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২১, ১২:৪৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১, ২০২১, ১২:৪৭ এএম

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভাস্কর্য ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি আজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি আজ
কার্জন হল - ফাইল ছবি

ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নির্মাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘অপরাজেয় দুর্গ’ খ্যাত ঐতিহ্যবাহি এই বিদ্যাপীঠের শতবষপূর্তি আজ।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এবং জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি আজ (বৃহস্পতিবার)। শিক্ষা-গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে পথচলা শুরু হয় ঢাবির।

৩ অনুষদ, ১২ বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ শিক্ষার্থী এবং ৩ আবাসিক হল নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে ১৩ অনুষদ, ৮৪ বিভাগ, ১৩ ইনস্টিটিউট, ১৯৮৬ জন শিক্ষক, প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী এবং ১৯টি আবাসিক হল ও ৪টি হোস্টেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাই তাদের প্রতি যাদের অনবদ্য অবদানে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলতে চলতে আজ মহীরুহে। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার প্রতি- শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীদের।’

অপরাজেয় বাংলা

উপাচার্য বলেন, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাঁথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোভিড-১৯ আক্রান্ত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশে আমরা এগিয়ে চলছি। শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্র জোরদার করার জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া’ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাণীতে উপাচার্য আরও বলেন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা সবার সদয় সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।

• শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাবির কর্মসূচি

চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় দিবসটি উপলক্ষে ক্যাম্পাসে সশরীরে কোনো অনুষ্ঠান হবে না, তবে অনলাইনে প্রতীকী কর্মসূচি পালিত হবে। শতবর্ষপূর্তির মূল অনুষ্ঠান বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে আগামী ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) অনলাইন প্রতীকী কর্মসূচির অংশ হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এদিন বিকেল ৪টায় এক ভাচুর্য়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল বক্তা হিসেবে সংযুক্ত থাকবেন ভাষাসৈনিক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ: ফিরে দেখা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেবেন।

স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নেটিজনেরা একে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলেও সম্বোধন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব জনআন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৯ বছর শেষ করে শতকের ঘরে পা দিচ্ছে আজ।

টিএসসি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইস রয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতা। ওই বছরের  ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি. আর. কুচলার, ড. রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি. আর্চিবল্ড, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদ্রাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেম্স্, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক এবং সংস্কৃত কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ সতীশ্চন্দ্র আচার্যকে সদস্য করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়।

১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’।

ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবনগুলো ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো ছিল— সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন।

মধুর ক্যান্টিন

প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন— হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ. সি. টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বা পরবর্তী সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

 ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সব জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীসহ শহীদ হয়েছেন অনেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের আইয়ুব সরকারের জারি করা অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ জারি করেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০ জন। পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৮ জন শিক্ষক।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিচ অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও অগ্রগতিতে নিবেদিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা-কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

জাগরণ/এসকে