• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০১৯, ০৫:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৫, ২০১৯, ১১:১৩ পিএম

৩ জেলার ৫ খনিতে মজুদ ৩১৯৭ মিলিয়ন টন কয়লা

৩ জেলার ৫ খনিতে মজুদ ৩১৯৭ মিলিয়ন টন কয়লা
দীঘিপাড়া কয়লাখনি-ছবি : জাগরণ

উত্তরাঞ্চল ও দেশের একমাত্র স্বল্পমাপসম্পন্ন দিনাজপুর জেলাধীন পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ‘ওপেন মাইনিং’ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন না করায় ভূ-গর্ভেই থেকে যাচ্ছে ৮০ ভাগ কয়লা। 

খনি উত্তোলন কর্তৃপক্ষ সাময়িক লাভের দিক তাকাচ্ছেন কিন্তু ৮০ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব হচ্ছে না। আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে ভূ-গর্ভ থেকে মাত্র ১৫-২০ শতাংশ কয়লা তোলা সম্ভব। ১৪০০ ফিট নিচ থেকে সুড়ঙ্গপথে কয়লা তোলা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে কয়লা উত্তোলন করা হলেও এতে শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে উন্নত-প্রযুক্তি ‘ওপেন পিট’ পদ্ধতিমতে কয়লা উত্তোলনে খরচ কম বা নিরাপত্তার ঝুঁকি কম এবং ৯০ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব। 

দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য উত্তরাঞ্চল দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি প্রকল্পটিকে ১৯৯৪ সালের ৭ জানুয়ারি ছোটমাপের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য সরকার পদক্ষেপ নেন। অল্প সময়ের মধ্যে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চীনের মেসার্স চায়না মেশিনারিজ ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)-এর সাথে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৯৪ সালের ১ জুন। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাসের মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিটি বাস্তবায়নের জন্য বড়পুকুরিয়া এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৯৯৮ সালের ৫ এপ্রিল খনির ভূ-গর্ভে পানি প্রবাহের কারণে খনিতে বিপর্যয় দেখা দেয়ায় কয়লাখনি প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে প্রায় ২২ মাস। ২০০৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ করার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।পরবর্তীতে খনি কর্তৃপক্ষ ডিজাইন পরিবর্তন করে এক নতুন ডিজাইনে কয়লা উত্তোলন সিদ্ধান্ত নেন। তবে এদিক-সেদিক করতেই প্রকল্পের কাজ ফের পেছায় আরও চার বছর। দীর্ঘ সময় এভাবে অতিবাহিত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় আরও ৫০০ কোটি টাকা।  প্রথম প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৮৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ওই সময় সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। উত্তরাঞ্চলে আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাখনি মজুদ আছে ৩,১৯৭ মিলিয়ন টন কয়লা। 

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে গ্যাসের ওপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। দেশে প্রধান জ্বালানির উৎস গ্যাস। আর দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণটাই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তাই আগামী দিনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে তিন জেলার পাঁচটি কয়লাখনি। দেশে আবিষ্কৃত কয়লা ৫৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য, যা দেশে এ পর্যন্ত আহরিত গ্যাসের প্রায় চারগুণ বেশি। 

দিনাজপুর জেলার আবিষ্কৃত তিন কয়লাখনি হচ্ছে- বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া। এছাড়া আরও দুটি খনির একটি হচ্ছে রংপুর জেলা পীরগঞ্জ উপজেলার খালাশপীরে, অন্যটি জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জে।

শুধু দিনাজপুর জেলায় আবিষ্কৃত কয়লাখনির ভূ-গর্ভে ১,৪৬২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ আছে। 

পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত  হলেও ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে এখনও কয়লা উত্তোলন হয়ে আসছে। এতে ৬ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার কয়লাক্ষেত্রে ১১৮ থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় ৬টি স্তরে কয়লা মজুদ ৩৯০ মিলিয়ন টন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির উৎপাদিত কয়লায় সালফারের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ।২০০১ সাল হতে ১৯ জুলাই ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বমোট কয়লা উৎপাদিত হয়েছে ১০১ কোটি ৬৬ লাখ ৪ হাজার ২৩৩ মেট্রিকটন। যার উৎপাদিত কয়লার মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি  টাকা দাঁড়ায়। 

১৯৮৫ সালে বিওএইচপি নামক বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আরও একটি কয়লাখনি আবিষ্কার করেন। ১৯৯৭ সালে লন্ডনভিত্তিক ‘এশিয়াএনার্জি’ নামে একটি বহুজাতিক কোম্পানি এই এলাকায় ১০৭টি কূপ খননের মাধ্যমে উন্নতমানের কয়লা আবিষ্কার করে। এই কয়লাখনিতে ৬ দশমিক ৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে বলে জানান। 

ফুলবাড়ী পৌর শহরের কিছু অংশ, পার্বতীপুরের একটি ইউনিয়ন, নবাবগঞ্জের দুটি ইউনিয়ন, বিরামপুরের একটি ইউনিয়ন নিয়ে এই বিশাল এলাকাজুড়ে বড়মাপের কয়লাখনিটি আবিষ্কৃত হয়। তারমধ্যে বিদেশি কোম্পানিটি ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যার অর্ধেকের বেশি ব্যয় করেছে ফুলবাড়ীর কয়লাখনি বাস্তবায়নে। কিন্তু সরকারি নির্দেশ না পাওযায় বহুজাতিক কোম্পানিটি কোন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। অন্যদিকে নানা রকম বাধা আর আন্দোলনে ফুলবাড়ীর কয়লাখনি আলোর মুখ দেখছে না। 

নর্থ ও  সাউথ দুটি এলাকাকে কোল জোন তৈরি করে এরইমধ্যো জরিপের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বছর চারেকের মধ্যে ‘ওপেন মাইনিং’ বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের নতুন পরিকল্পনা চলছে। এতে সরকারকে নতুন করে ওইসব এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। 

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে প্রতি ঘণ্টায় পানিপ্রবাহ রয়েছে ১ হাজার ৮০০মিটার কিউবিক, সেসঙ্গে রয়েছে রূফ ফল্ট। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কয়লা উত্তোলন চলছে। তবে নিকটবর্তী ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয় এই খনির কারণেই। এখানকার কয়লা দিয়েই ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়েছে। 

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দীঘিপাড়া কয়লাখনি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর আবিষ্কার হয়। দীর্ঘ এক যুগ ধরে বেশ কয়েকটি কূপ খনন করে ৫০০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদের পরিমাণ যাচাই করেই চুপচাপ রয়েছে। কেবল বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিসিএমসিএল-এর মাধ্যমে ৩ বছর মেয়াদি জরিপ কাজ চলমান রয়েছে। জরিপ শেষে চীনা কোম্পানি দীঘিপাড়া কয়লাখনিটি বাস্তবায়ন পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে। এই খনিটির তদারক করছেন প্রকল্প পরিচালক জাফর সাদিক। 

উত্তরাঞ্চলের চতুর্থ কয়লাখনি হচ্ছে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। ১৯৬৫ সালে সার্ভে করে ভূ-গর্ভের মজুদ কয়লা নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। ভূ-গর্ভের ৯০০ হতে ১০০০ গভীর পাশাপাশি ১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে কয়লা স্তর। 

পঞ্চম কয়লাখনিটির অবস্থান হচ্ছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার খালাশপীর নামক স্থানে। ১৯৯৫ সালে আবিষ্কৃত ১১ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ২৫৭-৪৮৩ মিটার গভীরতায় কয়লার মজুদ আছে ৬৮৫ মিলিয়ন টন। 

এই পাঁচটি খনির মজুদকৃত কয়লা জ্বালানি খাতে সহায়ক ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নখাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে সংশ্লিষ্ট মহলের মন্তব্য। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঅঞ্চলের যেসব কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশীয় অর্থে তৈরি করা হয়েছে কয়লা সরবরাহ না থাকলে এসব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। 

সরকার উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি কয়লাখনি বাস্তবায়ন না করে তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভর হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। বিদ্যুতের অভাবে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হলেও অর্থনৈতিকভাবে গুনতে হয় লোকসান। 

উন্মুক্ত-পদ্ধতিতে কয়লাখনিগুলো বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। কিন্তু সরকার ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া কয়লাখনি দু’টি উন্মুক্ত-পদ্ধতিতে করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন খনি বিশেষজ্ঞরা। চীনা কোম্পানিকে দিয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে এই খনিগুলোর ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লার অফুরন্ত ক্ষতিসাধন হবে। ৮০ভাগ কয়লা ভূ-গর্ভে থেকে যাবে। ২০ ভাগ কয়লাও উঠবে না বরং ব্যয় বাড়বে সরকারের। 

জার্মানির মত উন্নয়নশীল দেশ তাদের ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লা ‘ওপেন পিট’ পদ্ধতিতে তুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তাদের দেশের কয়লা বাংলাদেশের মতো নয়, তারা চিন্তা করে আগামী ৫০ বছরের জন্য জ্বালানি মজুদ করার। সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে এমনকি খনি এলাকার কিছু মানুষকে অন্যত্র পুনর্বাসন করেছে। তাদের দেশের পরিবেশের কোনও ক্ষতি হয়নি। কিছু সমস্যা রয়েছে যে সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিল পুনর্বাসন, চাকরি এবং জীবন-জীবিকার জন্য উন্নত ব্যবস্থা করা। সে দেশের সরকার তাই করেছে। জার্মানির সেসব অভিজ্ঞতা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে তো কয়লা উত্তোলন অতি সহজ ব্যাপার। অপরদিকে জ্বালানি সঙ্কট রয়েছে উত্তরাঞ্চলে। কয়লা পুড়িয়ে এই এলাকার জ্বালানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাতে এই এলাকায় কৃষি ও শিল্পতে বিপ্লব ঘটবে। 

পাঁচটি কয়লাখনি বাস্তবায়ন করা হলে এতে দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটা সম্ভব। এ বিষয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান জাগরণকে বলেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির নতুন কূপ খননের জরিপ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে দীঘিপাড়া কয়লাখনির জরিপের কাজ এ বছরেই সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

এসএমএম