ঠিক যে জায়গায় গতবার আলোচনাটা থেমেছিল, সেখান থেকে আবার শুরু হতো... মাঝখানে হয়তো বছরখানেক গড়িয়ে গিয়েছে। তাপস পাল আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কটা ঠিক সে রকমই।
আশির দশকের শুরুতেই দু’জনের ক্যারিয়ারের সূচনা। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী, আবার বন্ধুও। দু’জনের পারস্পরিক সমীকরণ একটা অদ্ভুত গ্রন্থিতে বাঁধা ছিল বরাবর।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে দুর্ঘটনার মতোই আছড়ে পড়ে তাপস পালের মৃত্যুসংবাদ। সাধারণ মানুষ যতটা হতবাক, প্রসেনজিৎও তাই। তাপসকে নিয়ে লেখার অনুরোধ করা হলে জানিয়ে দিলেন, কলম ধরার মতো মানসিক অবস্থায় নেই তিনি।
তবু টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি উঠে এল প্রসেনজিতের পাঠানো বার্তা থেকে।
বাংলা ছবি যে সময়টায় একজন দক্ষ অভিনেতার অভাব অনুভব করছিল, ঠিক সেই সময়েই ‘গুরুদক্ষিণা’ মুক্তি পেল। আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম। বাংলা সিনেমা আজ এক নক্ষত্রকে হারাল। আর আমি একজন প্রকৃত বন্ধুকে।
আশির দশকে বাংলা সিনেমার নায়ক বলতে চিরঞ্জিৎ-তাপস-প্রসেনজিৎ। কখনও তারা একসঙ্গে ছবি করছেন, কখনও অন্যের শুটিংয়ে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন, কখনও বা নির্ভেজাল আড্ডায় বসছেন। এই প্রজন্মের অভিনেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রসেনজিৎ একবার বলেছিলেন, ‘এখনকার অভিনেতাদের মধ্যে বাঁধন দেখি না। হয় সকলেই সকলের বিরুদ্ধে, নয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখনদারির পিঠচাপড়ানি। আমাদের সময়ে এটা ছিল না। পর্দার বাইরেও তাপস-আমি ভাল বন্ধু ছিলাম। কোনও আলোচনা হয়তো একটা জায়গায় থেমেছিল, অনেক দিন পরে দেখা হলে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হতো। আমাদের দেখলে কেউ ভাবতো, এরা বোধহয় রোজ আড্ডা দেয়। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও, দু’জনেই দু’জনের খবর রাখতাম।’
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ছাপিয়ে প্রসেনজিৎ বন্ধুত্বের কথা বললেও, ইন্ডাস্ট্রিতে অন্য গুঞ্জন শোনা যেতো সে সময়ে। বলা হতো, প্রসেনজিৎ যেভাবে নিজের ক্যারিয়ার বিস্তার করেছেন, তাতে অন্যরা খানিকটা কোণঠাসা হয়েছেন। এর জন্য তাপস নিজেও খানিক দায়ী বলে মনে করেন ইন্ডাস্ট্রির প্রবীণরা। তার ওপরে রাজনীতিতে আসায় ইন্ডাস্ট্রির অনেকের সঙ্গেই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাপসের। উপরন্তু রোজভ্যালি কাণ্ড, জেলে যাওয়া তাপসকে আরও প্রান্তিক করে দিয়েছিল। সে সময়ে প্রসেনজিৎও হয়তো তাকে এড়িয়ে গিয়েছেন। এমনিতেও তিনি রাজনীতি-বিতর্ক থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু মৃত্যু আজ তাকে ভারাক্রান্ত করেছে। তাই অকপটে বললেন, তাপস আমার চেয়ে অনেক বড় স্টার ছিল। চিরকাল থাকবেও।
প্রসেনজিৎ যেভাবে নিজের ক্যারিয়ার সাজিয়েছেন, নিজেকে যেভাবে মেনটেন করেছেন, তাপস কোনও দিনই তেমনটা ছিলেন না। ক্যারিয়ারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। শরীরও সঙ্গ দিচ্ছিল না। প্রসেনজিতের মতে, তাপস বড় খামখেয়ালি। শরীরের দিকে নজর দিত না। প্রসেনজিৎ নিজেও তাপসকে সাবধান করেছেন বহুবার।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দস্তুর, মৃত্যুদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করা। প্রসেনজিৎও তার বাইরে নন। কিন্তু তার সমসাময়িক অভিনেতার অকস্মাৎ মৃত্যু প্রসেনজিৎকে এতটাই ধাক্কা দিয়েছে যে, এদিন সোশ্যাল মিডিয়াতেও নির্লিপ্ত রইলেন। অবশ্য নির্ধারিত শিডিউল মেনে অভিনেতা মঙ্গলবার শুটিং করেছেন।
ইন্টারনেটের তথ্য বলছে, অনুপ সেনগুপ্তের ‘মায়ের আঁচল’-এ তাপস-প্রসেনজিৎ শেষ বারের মতো একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। প্রসেনজিৎ অবশ্য তা নিশ্চিত করতে পারছেন না। সহকর্মীর বিদায়বেলায় স্মৃতিও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাদের শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রসেনজিৎ ছোটপর্দার জন্য ‘মহানায়ক’-এর শুটিং করছিলেন। সেই স্টুডিওতেই চলছিল তাপসের ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ ধারাবাহিকের শুটিং। ওই সময়ে মেকআপ রুমে বসে আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছিলাম। তখনও ভাবেননি, সেই আড্ডাই শেষ। আনন্দবাজার।
এসএমএম