• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২০, ০২:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৫, ২০২০, ০৩:০১ পিএম

আর ভাঙেনি নীরবতা, ফুরালো ‘শেষের কবিতা’

আর ভাঙেনি নীরবতা, ফুরালো ‘শেষের কবিতা’
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

অবশেষে সত্য হলো তাই। সেই নিস্তব্ধ নীরবতাই ছিল তার শেষের কবিতা। এরপর আর একটি চরণও উচ্চারণ করেননি এই আবৃতি প্রেমিক। চলে গেলেন বাংলা অভিনয় জগতের অন্যতম কিংবদন্তী অভিনেতা, ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের মহেন্দ্রজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হাসপাতালের বিছানায় গত ৪০ দিন ধরে জীবন-মৃত্যুর দর কষাকষি শেষে ঝরে গেলেন প্রবীণ এই মহাতারকা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র ছিলেন একই সঙ্গে একজন অভিনেতা-নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি ও চিত্রকর। রোববার দুপুর সওয়া ১২টায় মধ্য কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। 

নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেপ্টেম্বের বেলভিউয়ে ভর্তি হন সৌমিত্র। তিনি একটা সময়ে ক্যানসারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই অসুস্থতা স্বভাবতই তাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ফলে কখনও উন্নতি কখনও অবনতি, এই দোলাচলেই চলছিল হাসপাতাল-বন্দি সৌমিত্রর জীবন। এ ছাড়াও একাধিক কোমর্বিডিটি ছিল তার। তার জেরে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে তার। তবুও প্লাজমা থেরাপি, শ্বাসনালিতে অস্ত্রপচার-সহ নানা ভাবে অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা।

...অনেকক্ষণ বকলাম। অ্যা লাইকলি মেরিট ফর দ্য স্টেজ।’ যার সম্পর্কে তার এমন মূল্যায়ণ; এর ক্ষণিক আগেই একঝাড় বকুনি দিয়েছিলেন তাকে। তিনি আর কেউ নন, ২২ বছরের টগবগে সেই তরুণ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু শুক্রবার সৌমিত্রর শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটে। হৃদযন্ত্র আর কিডনির জটিলতা অনেকটা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ‘হার্ট রেট’। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।  চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, অলৌকিক কিছু না ঘটলে সৌমিত্রের সুস্থ হয়ে ওঠা অসম্ভব। তার পরই দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে আসে অনুরাগীদের মধ্যে।

অভিনয় শৈলীতে মহানায়ক বা মহানায়কের মত কেউ হয়ে ওঠা হয়নি তার। কিন্তু তিনি সৌমিত্র হয়েছিলেন। শৈল্পিক দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি বহুমাত্রিক চরিত্রায়ণের অসামান্য গুনের বলে অভিনয় জগতে নিজের উদ্ভাসিত আত্মপ্রকাশ দিয়েছিলেন এক অনন্য স্বকীয়তায়। পঞ্চাশের দশকে নাট্য-সমালোচক হিসেবে নাট্যাচার্যের খাতায় তৎকালীন এক ষষ্ঠ বর্ষী ছাত্রের কথা লিখেছিলেন শিশির ভাদুড়ি। তিনি লিখেছিলেন, ‘...অনেকক্ষণ বকলাম। অ্যা লাইকলি মেরিট ফর দ্য স্টেজ।’ যার সম্পর্কে তার এমন মূল্যায়ণ; এর ক্ষণিক আগেই একঝাড় বকুনি দিয়েছিলেন তাকে। তিনি আর কেউ নন, ২২ বছরের টগবগে সেই তরুণ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য পরে সেই তরুণকেই শিশির ভাদুড়ি সুযোগ করে দিয়েছিলেন তার প্রফুল্ল নাটকের সুরেশ চরিত্রে আত্মপ্রকাশের। বাংলা অভিনয় জগতে সৌমিত্র শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অভিনয় ব্যক্তিত্ব, অভিনয় শিল্পের এক পূর্ণাঙ্গ 'গুরুকুল'।

১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নদিয়ায় জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই বর্ষীয়াণ অভিনয় শিল্পী। ডাকনাম ছিল পুলু। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে পাশ করার পর সৌমিত্র সিটি কলেজ থেকে আইএসসি ও বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টসে। কলেজে পড়তে পড়তেই দেখেছিলেন শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরিচয় হয় ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে, শুরু হয় মঞ্চে অভিনয়। অসমবয়সী দুই অভিনেতার মধ্যে গড়ে ওঠে অদ্ভুত বন্ধুত্ব, যার কথা বারবার উঠে এসেছে সৌমিত্রের স্মৃতিচারণে।

নীলাচলে মহাপ্রভু ছবি দিয়ে বড় পর্দায় পা রাখার কথা ছিল। কিন্তু বাদ পড়েন একেবারে শেষ মুহূর্তে, সুযোগ পান অসীম কুমার। এরপর ১৯৫৬। সত্যজিৎ রায় তখন অপরাজিত-র জন্য খুঁজছেন নতুন মুখ। ২০ বছরের সৌমিত্রকে পছন্দ হয় তার কিন্তু মনে হয়, কিশোর অপুর পক্ষে একটু বেশি লম্বা। কেটে যায় ২ বছর। সত্যজিৎ তখন জলসাঘর নিয়ে ব্যস্ত। দেখা করতে গিয়েছেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ তাকে নিয়ে যান ছবি বিশ্বাসের কাছে। বলেন, ‘এ হল সৌমিত্র, আমার পরের ছবি অপুর সংসার-এ অপু চরিত্রে অভিনয় করছে।‘ তারপরের অধ্যায় চিরকালীন স্থান পেয়েছে বাংলা ছবির ইতিহাসে।

বিভূতিভূষণের যে শিশু অপু দিদির হাত ধরে অবাক চোখে দুনিয়া চিনেছিল, সে তখন সদ্য তরুণ। জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছে, পাকেচক্রে বিয়েও করে ফেলেছে। বাঙালি মননে অমরত্ব পেয়েছে অপু আর তার কিশোরী পত্নীর সদ্য ফোটা রোমান্স। তারপর স্ত্রীর মৃত্যু, ছেলেকে কাঁধে বসিয়ে যুবক অপুর যাত্রা দিকশূন্যপুরের দিকে। অপূর্বকুমার রায়ের অতি অসামান্য, অতি অকিঞ্চিৎকর জীবন এত অনায়াসে কে ফুটিয়ে তুলতে পারত সৌমিত্র ছাড়া?

বাংলা সিনেমার আকাশে তখন দুপুরের উজ্জ্বলতায় জ্বলছেন উত্তর কুমার। রয়েছেন কমল মিত্র, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কালজয়ী অভিনেতারা। সেই সোনার সময়েও বাঙালি দর্শকের নজর আলাদা করে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সৌমিত্র।

সৌমিত্র যখন এলেন, বাংলা সিনেমার আকাশে তখন দুপুরের উজ্জ্বলতায় জ্বলছেন উত্তর কুমার। রয়েছেন কমল মিত্র, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কালজয়ী অভিনেতারা। সেই সোনার সময়েও বাঙালি দর্শকের নজর আলাদা করে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সৌমিত্র। শুধু সত্যজিতের পরপর ছবিতে অভিনয় নয়, তপন সিংহের ঝিন্দের বন্দি-তে তিনি প্রমাণ করলেন, খল চরিত্রেও তিনি একইরকম স্বচ্ছন্দ। যে সৌমিত্রকে বাঙালি দর্শক চিনেছিল দেবী, সমাপ্তি-র মত ছবিতে, তিনিই হয়ে উঠলেন ময়ূরবাহন, যার রূপ ছিল চোখ ঝলসানো, ভেতরটাও ছিল ততটাই ক্রূর।

সত্যজিতের সব থেকে পছন্দের নায়ক। অপুর সংসার থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা থামল ১৯৯০-এ শাখা প্রশাখা-য়। সব মিলিয়ে ১৪টি ছবি। চারুলতা-র অমলই হোক বা হীরক রাজার দেশে-র উদয়ন পণ্ডিত- বিশপ লেফ্রয় রোডের বাসিন্দার ছবি মানেই সৌমিত্রের উপস্থিতি। সত্যজিৎ ফেলুদা করলেন, সেখানেও তিনি মুখ্য চরিত্র। আর বাঙালি পেল নতুন ফ্যাশন, পাঞ্জাবির সঙ্গে প্যান্ট, ধুতি বা পাজামার বদলে।

১৯৬০-এ বিয়ে করেন সৌমিত্র। স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়, দুই সন্তান, সৌগত এবং পৌলমী। ১৯৬১ সাল সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে মাইলফালক। ওই বছরই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবিতে সৌমিত্রকে প্রথম দর্শক পেয়েছিলেন একটি খলচরিত্রে। নাম ‘ময়ূরবাহন’। যে অভিনেতা ‘অপু’ হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ বা ‘সমাপ্তি’-তে যে নায়ক ঝড় তুলেছেন, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা দিলেন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত ‘সুদর্শন ও লম্পট’ যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্রকে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের।

১৯৮৪-তে মুক্তি পেল কোনি। তনুজাকে দেখে এক সময় রাস্তায় ট্যুইস্ট নাচা তরুণ সৌমিত্র তখন মধ্যবয়সী, সাঁতার শেখাচ্ছেন বস্তির মেয়ে কোনিকে, দিচ্ছেন জীবনযুদ্ধে ট্রেনিং। তার সেই ফাইট কোনি ফাইট চিৎকার বাংলা ছবিতে মাইলস্টোন হয়ে আছে।

এরপর আতঙ্ক। সেই হাড়হিম করা হুমকি, মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি। আচমকা খুনের সাক্ষী হওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের অসহায়তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল দর্শককে। আর সৌমিত্র বুঝিয়েছিলেন, তার অভিনয়ের রেঞ্জ সম্পর্কে সত্যি আমরা কত কম জানি।

১৯৭০-এ প্রথমবার তাকে পদ্মশ্রী প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল ভারত সরোকার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, ওই সময়টা সরকার চলচ্চিত্রের জন্য কিছু করেনি, তাই আলাদা করে ব্যক্তি হিসেবে পুরস্কার নিতে চাননি। ২০০৪-এ পান পদ্মভূষণ, ২০১২-য় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, তার ৬ বছর পর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান লেজিয়ঁ দ্য'নর, একই বছরে শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান কমান্দার দ্য ল'র্দ্র দেজার্ত এ দে লেত্র। কিন্তু শুধু তো চলচ্চিত্র নয়, সৌমিত্র মানেই মঞ্চাভিনয়, আবৃত্তি, কবিতাচর্চা, সাহিত্য সৃষ্টি সহ এক সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব, গোটা জীবন যাঁর আত্ম আবিষ্কার থামেনি। টিকটিকি, কিং লিয়র-এর মত নাটকে তার অভিনয় দর্শক মনে রেখেছেন ভালবাসা ও শ্রদ্ধায়।

কিন্তু সব কিছুর পরেও সৌমিত্রর কথা ভাবলে যেন সেই কোনি-র 'ক্ষিদ্দা'র কথাই মনে পড়ে। জীবনযুদ্ধে কোণঠাসা মধ্যবয়সী সাঁতার মাস্টার আঁকড়ে ধরেছেন কিশোরী ছাত্রীকে, তার জয় পরাজয়ে আটকে রয়েছে তার জীবনের ওঠানামা। ছবির শেষ কয়েক মিনিটে তলোয়ারের মত ঝলসে উঠেছিল সৌমিত্রের কালজয়ী প্রতিভা, অপু, উদয়ন পণ্ডিত, ময়ূরবাহনরা যেন মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল ছাপোষা ক্ষিতীশ সিংহের মধ্যে। বাংলা ছবির ছোট্ট চণ্ডীমণ্ডপকে মুহূর্তে আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত করেছিল সৌমিত্রের অভিনয়। সিনেমা যতদিন মানুষের মনের কথা বলবে, ততদিন থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তার এক আকাশ অভিনয় দক্ষতা নিয়ে।

অতৃপ্তি থেকে অভিনয়ের খিদে, জীবনের অপূর্ণতা থেকে লড়াইয়ের রাস্তা ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাকে। অন্যচোখে দেখা তাকে শুধু অভিনেতাই নয়, একজন শিল্পী করে তুলেছে। যাঁর সবচেয়ে পছন্দের চেহারার হিন্দি সিনেমার হিরোর নাম বলরাজ সাহনি। কারণ, বলরাজের বোধি আর দীপ্তি। এত দীর্ঘসময় কেন অভিনয় করে গেলেন তিনি? আত্মপ্রদর্শনের তাগিদে? না কি গ্ল্যামারের হাতছানিতে? না কি মুদ্রারাক্ষসীর মোহিনী মায়াজালে পড়ে? কোনওটাই নয়। আসলে তার অভিনয় তার জীবনকে পেরিয়ে গিয়েছিল। যখন অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়। উন্নততর মানুষ হওয়ার সাধনা যাত্রাপথের লক্ষ্য হয়ে উঠতে থাকে। উৎকৃষ্ট অভিনেতা হওয়ার পথ এবং উন্নত মানুষ হওয়ার পথ তখন অভিন্ন হয়ে যায়। সেই যাত্রার প্রধান প্রেরণা একটি চার-অক্ষরি শব্দের মধ্যে অনন্ত শয়ানে এলায়িত হয়ে থাকে। ভালবাসা। চলে গেলেও সৌমিত্র বলে যান—

‘পুরস্কার তিরস্কার কলঙ্ক কণ্ঠের হার
তথাপি এ পথে পদ করেছি অর্পণ,
রঙ্গভূমি ভালোবাসি হৃদে সাধ রাশি রাশি
আশার নেশায় করি জীবন যাপন’।